পৃথিবীর প্রথম সুগন্ধি এসেছে ব্যাবিলিয়নদের হাত ধরে। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর আগে ব্যাবিলিয়নের নারী রসায়নবিদ তাপ্পুতি সুগন্ধি তৈরিতে সফলতা অর্জন করেন। ভারতীয় সভ্যতায় বৈদিক আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রেও সুগন্ধি তৈরির উল্লেখ রয়েছে। বাষ্পীভূতকরণের মাধ্যমে সুগন্ধি শিল্পে বিপ্লব ঘটলেও মূলত গত দুই দশকে রসায়নবিদরা উত্তরোত্তর নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন সৌরভ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এখন চিন্তা করা হচ্ছে জৈব প্রযুক্তির কথা। জৈব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের সুগন্ধি তৈরির পথে হাঁটছেন বিজ্ঞানীরা।
সুগন্ধি তৈরির কৌশল বেশ জটিল এক বিজ্ঞান। ব্যবহার উপযোগী সুগন্ধির জন্য সবার আগে চিন্তা করতে হয় কোন উত্স থেকে সংগ্রহ করা হবে সুগন্ধির কাঁচামাল। এরপর জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুগন্ধির জন্য নির্দিষ্ট উত্স থেকে গন্ধ সংগ্রহ করা হয়। সুগন্ধির কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে রসায়নবিদদের প্রথম পছন্দ প্রকৃতি। ফুল, লতা, গুল্ম থেকে সংগ্রহ করা নির্যাসকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয় সুগন্ধি। সুগন্ধিযুক্ত ফুল আর লতাগুল্মকে বিশেষ ধরনের তেলে নিমজ্জিত করে জটিল প্রক্রিয়ায় ‘রেজিন’ সংগ্রহ করা হতো। এরপর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সংগ্রহ করা হতো গন্ধ। একাদশ শতক পর্যন্ত সুগন্ধি তৈরিতে এই পদ্ধতির প্রচলন বেশি ছিল। এরপর ভিক্টোরিয়ান যুগে শিল্প বিপ্লবের বিকাশ ঘটায় আরো খানিকটা অগ্রগতি হয় সুগন্ধি শিল্পে।
ঐ সময়ে রসায়নবিদরা প্রকৃতির গন্ধযুক্ত উত্স থেকে একাধিক গন্ধের থেকে একক গন্ধ বিশ্লেষিত এবং সংশ্লেষিত করতে সমর্থ হন। এরপর সংশ্লেষিত সেই একক থেকে সুগন্ধি তৈরি করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন কেউ কেউ। সুগন্ধি নির্মাতা আর্নেস্ট বিউয়াক্স অতিমাত্রায় ‘অ্যালডেহাইডস’ ব্যবহারে ‘চ্যানেল নম্বর ৫’ তৈরি করে রাতারাতি খ্যাতি লাভ করেন। একইভাবে ‘হেডিওন’ থেকে এডমন্ড রাউন্ডনিটতসকা তৈরি করেন ‘ইউয়া সয়েভেজ’।
১৯৮০ সালে সুগন্ধি হাউজ ‘ইন্টারন্যাশন ফ্লেভারস এন্ড ফ্রাগরেন্সেস’ হেডস্পেস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুগন্ধিযুক্ত বস্তু সুগন্ধির অনু (ক্ষুদ্র একক) সংগ্রহ করতে থাকেন। অদৃশ্য এই গন্ধকে অনেকটা দৃশ্যমান করতে সমর্থ হন বিজ্ঞানীরা। যে কোনো বস্তুর ছবি তুলে যেমন এটিকে দৃশ্যমান করা যায় সুগন্ধির ক্ষেত্রেও তেমন অগ্রগতি লাভ করেন তারা। ল্যাবরেটরিতে একাধিক সুগন্ধির অণুর মধ্যে সংযোজন-বিয়োজনের মতো কাজ করতে সমর্থ হন তারা। ফরাসি সুগন্ধি শিল্পী ফ্রেডরিক ম্যালে তার বিখ্যাত সুগন্ধিগুলো তৈরি করেছেন হেডস্পেস প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। জনপ্রিয় ‘কার্নাল ফ্লাওয়ার’ সুগন্ধি তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছেন আলাদা তিনটি সুগন্ধি অণু।
তবে সুগন্ধির জগতে বিপ্লব ঘটাতে পারে জৈব প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ফুলের নির্যাস থেকে সুগন্ধ সংগ্রহ করার প্রয়োজন পড়বে না বরং বিজ্ঞানীরা এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন যেখানে ফুল থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া গন্ধ সংগ্রহ করা হবে। এই গবেষণাটি করছে লন্ডনের ওলফা ল্যাবের বিজ্ঞানীরা। বাতাস থেকে সংগ্রহ করা গন্ধের অনুগুলোকে পরবর্তীতে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষিত এবং সংশ্লেষিত করে তৈরি করা হবে কাঙ্ক্ষিত সুগন্ধি। ওলফা লাবের কো-ফাউন্ডার ওসকার স্পিয়ার বলেন, ডিজিটাল অণুগুলো থেকে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সুগন্ধি তৈরির জন্য সবার আগে ডিজিটাল অঙ্গ তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মূলত এই ডিজিটাল অঙ্গের উপরেই জোড়া লাগানো হবে ডিজিটালি সংগ্রহ করা সুগন্ধি অণুগুলোকে। এটি করতে পারলে আর সুগন্ধি তৈরির জন্য ফুলের নির্যাসের পেছনে ছুটতে হবে না। বাতাসে ছড়ানো সুগন্ধি ফুলের সৌরভ থেকে জৈব প্রযুক্তিতে তৈরি হবে আগামীর সুগন্ধি।