টেকনাফের শামলাপুর স্কুল মাঠে ত্রাণের জন্য ঘুরছিলেন মিনারা বেগম। কোলে এক বছরের শিশু। গত তিন দিন হলো নিজের জন্য তেমন কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। মেয়ের জন্য শুধু একটি পানির বোতল কিনে দিয়েছিলেন কোনো এক হৃদয়বান মানুষ। সকালে খবর পান স্কুল মাঠে ত্রাণ দেয়া হবে। তাই ভোর থেকেই এখানে আসেন তিনি। বেলা বয়ে যায়। কিন্তু ত্রাণের খবর নেই। কোলের শিশুটি কাঁদছে। কাঁদছেন মাও। কারণ অন্য চারটি শিশুও এখনো কিছু খায়নি। অথচ সন্তানদের বলে এসেছেন দ্রুত খাবার নিয়ে ফিরবেন। বেলা ১টায় স্কুল মাঠে দেখা হয় মিনারার সঙ্গে।
ত্রাণ না পেয়ে স্থানীয় লোকজনের কাছে টাকার জন্য হাত পাতছিলেন তিনি। বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন, হয় টাকা দাও, নয়ত খাবার দাও। আমার পাঁচটি সন্তানকে তোমরা বাঁচাও। কিন্তু অসহায় এই নারীকে সহযোগিতা করার জন্য তেমন কেউ ছিলেন না। তার কান্না দেখে কথা হলো এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। কোথা থেকে আসছেন জিজ্ঞেস করতেই মিয়ানমারের দিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখালেন। এরপর যেন আর কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছিলেন না তিনি।
বর্ণনা দিলেন ফেলে আসা এক হৃদয়বিদারক ঘটনার। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একজন তিনি। মংডুর দংহালি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। সম্প্রতি নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। সেনাবাহিনী ও সে অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে। দিন দিন এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তিনি জানান, আমরা বেশ কিছুদিন শান্তিতেই ছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভোট হয়েছে। আমরা সবাই সুচির দলকে হাঁস মার্কায় ভোট দিয়েছি। কিন্তু তিনি তো আমাদের রক্ষা করতে পারলেন না। আমরা ভিটে-মাটি ছেড়ে আজ ভিন দেশে জীবন বাঁচাতে পাড়ি জমিয়েছি।
মিনারার কষ্টেও কথা এখানেই শেষ নয়। তিন মাসের শিশুকে হত্যার কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি। জানান, গেল নয় দিনের এক ঘণ্টাও ঘুমোতে পারি না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার সন্তানের হাসিমাখা মুখটি। যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। ‘আরকা’ আমাকে দেখে মনে হয় হাসছে। খেলছে। কখনো কখনো ওর কান্নার শব্দও শুনতে পাই। শুনতে পাই আর্তচিৎকার। আবার চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে আমার ছেলেনি, সে দৃশ্যও ভেসে ওঠে বারবার। চোখ ফোলা মিনারার। গায়ে জ্বর। ভালো নেই তিনি।
বাবার বাড়ি আর স্বামীর পরিবার মিলিয়ে ২০ জন সদস্য তারা। একসঙ্গে বসবাস। ১৭ জন জীবন নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বাকি তিনজনকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর মধ্যে একজন তার সন্তান, অন্য দু’জন বাবা-মা। একদিন হঠাৎ করেই স্থানীয় লোকজনসহ সেনাসদস্যরা গ্রামে হামলা চালায়। একের পর এক চলে হত্যাযজ্ঞ। চোখের সামনে মানুষকে কচুকাটা করা হয়েছে। আমার বাবা আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন অসুস্থ। বিছানায় পড়া। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মা হালেমা খাতুনকে উঠানে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রাণ ভয়ে বাচ্চাদের নিয়ে পাশে থাকা জঙ্গলে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমার ছেলে ঘরের বাইরে দোলনায় ছিল। তাকে আনতে পারিনি। বাবা-মাকে কোপানোর পর জ্বালিয়ে দেয়া হলো ঘর-বাড়ি। আশপাশের গ্রাম জ্বলছে। বাচ্চাদের মুখে রুমাল দিয়ে চেপে ধরে রাখি। যেন শব্দ না হয়। সর্বশেষ আমার ছেলেকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পাষণ্ডের দল। অবুঝ শিশুটি বাঁচার জন্য চিৎকার করছিল। কিন্তু মা হয়ে আমার করার কিছুই ছিল না। আগুন শান্ত হলো। পুড়ে ছাই হলো আমার ছেলেটি। এ দৃশ্য দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কথা বলতে পারিনি কয়েকদিন। কিন্তু অন্য সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই মিলে বাঁচার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, ২০ জনের মধ্যে তিনজন এখন আর আমাদের মাঝে নেই। ১৩ জন একসঙ্গে পাহাড়ের ওপর একটি ক্যাম্পে আছি। বাকি চারজনের কোনো হদিস নেই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও হয়নি। তবে চেনা লোকজনের কাছে খবর পেয়েছি তারাও দলছুট হয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছে। যোসাহেরা, জোৎস্না বেগম, তোফায়েল, হাসেম ও আইয়াজের মুখের দিকে সব সময় তাকিয়ে থাকি। ওদের মাঝে খুঁজে ফেরার চেষ্টা করি আমার আরকাকে। এবার বুক চাপড়াতে শুরু করেন মিনারা। চারপাশজুড়ে মানুষের জটলা হয়। তার কষ্টের কথা শুনে কেউ চোখে পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। অনেকে মিনারের সঙ্গে ডুকরে কাঁদলেন।
অনেক কষ্ট পেয়ে কোনো রকম জীবন নিয়ে চার ঘণ্টা সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে তাদের। তাই আর কখনোই সে দেশটিতে ফিরে যেতে চান না তিনি। বললেন, যত কষ্টই হোক এখানে থেকে যেতে চাই। সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার দৃশ্য যে দেশে দেখেছি সেখানে আর ফিরতে চাই না। ওখানে মানুষ আছে মানবতা নেই।