সরকারের মালিকানাধীন টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলের অবকাঠামো সম্প্রসারণের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের খরচ কমাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট তিনটি খাতে এই প্রকল্পের খরচ কমাতে গত মাসের একনেক বৈঠকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খরচ কমাতে দর-কষাকষি করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি করার নির্দেশনাও মানা হয়নি।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) এই প্রকল্পটি গত ১৭ অক্টোবরের একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে শর্ত হিসেবে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেডটিইর সঙ্গে আলোচনা করে খরচ কমিয়ে ডিপিপি (বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাযুক্ত এ চিঠি ২ নভেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের একনেক শাখা থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠানো হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি না করেই এরপর ১৩ নভেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে বিটিসিএলকে একনেকের নির্দেশ অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সংশোধিত ডিপিপি একই দিনে, অর্থাৎ ১৩ নভেম্বরেই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী বিটিসিএল একই দিনে ডিপিপি পুনর্গঠন করে তা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠায়। ২০১৬ সালে তৈরি মূল ডিপিপিতেও ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। সংশোধিত ডিপিপিতেও তা একই রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এক টাকা খরচ না কমিয়ে আগের ডিপিপি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠায় বিটিসিএল।
সারা দেশে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য ২০১৫ সালে ‘ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ (এমওটিএন)’ শীর্ষক এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। ২ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চীনের জেডটিই হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড ও জেডটিই করপোরেশনকে নির্বাচন করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ঋণ হিসেবে চীন থেকে আসবে ১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। বাকি ৭৫৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেবে। একই কাজের জন্য চীনেরই একটি কোম্পানি ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী সময়ে আরেকটি কোম্পানি ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গত এপ্রিলে প্রকল্পটির সুনির্দিষ্ট তিনটি খাতের খরচ কমানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। খাত তিনটি হলো এক্সেস নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতির দাম, কারখানা পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণ এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবার দাম কমানো। এ তিনটি খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৪ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৩৩৩ কোটি টাকা। একনেকের নির্দেশনাতেও এ তিনটি খাতেই দর-কষাকষির মাধ্যমে খরচ কমাতে বলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব শ্যাম সুন্দর সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিষয়বস্তু জানিয়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজ উদ্দিন আহমদের কার্যালয়ে গিয়ে ও ফোন করে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমওটিএন প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত খরচ ধরার বিষয়টি নিয়ে গত এক বছরে প্রথম আলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি ও ১ হাজার ২৪০ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক কেব্ল কেনার খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি ডলার বা ২৮০ কোটি টাকা। অথচ ২০১৫ সালে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে টিএনডিপি লট-বি নামের একটি প্রকল্পে ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি, ১ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক কেব্ল ও বেশ কিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কেনার খরচ ধরা হয়েছিল ২২৪ কোটি টাকা।
ঋণের শর্তে পরিবর্তন
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ৭ নভেম্বর বিটিসিএলকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, এমওটিএন প্রকল্পের জন্য বিবেচ্য চীনা ঋণ অনমনীয়। তাই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন। অথচ গত ১৭ অক্টোবর একনেক সভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত বক্তব্যে প্রকল্পের জন্য বিবেচ্য ঋণকে চীন সরকারের কনসেশনাল লোন বা বিশেষ ছাড়ের ঋণ বলা হয়েছিল।
স্মার্ট নিউজ টোয়েন্টিফোর