রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার সাভারে দুই নারী এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত পরিচয় দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। এ ছাড়া পাবনার চাটমোহর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে আরো কিন ব্যক্তি মারাত্মক আহত হয়। গত শুক্রবার রাতে ও গতকাল শনিবার এসব ঘটনা ঘটে।
এদিকে দেশবাসীকে ছেলেধরা গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রাজধানী : বাড্ডায় গতকাল নিহতের নাম তাছলিমা বেগম রেনু (৪২)। তিনি মহাখালী এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তাছলিমা বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। স্কুলের সামনের গেটে অভিভাবকরা তাঁর কাছে ভেতরে যাওয়ার কারণ জানতে চান। তাছলিমা জানান, তাঁর সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করবেন। এ সময় অভিভাবকদের কাছে তাঁর কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হলে তাঁরা তাঁকে ধরে প্রধান শিক্ষিকার কাছে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তাঁর বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি একেকবার একেক বাসার ঠিকানা বলেন। এতে সন্দেহ বাড়ে। স্কুলে ছেলেধরা এসেছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। সেখানে বাঁশের বাজারসহ আশপাশের এলাকার লোকজন ভিড় করে। কিছুক্ষণ পর তাছলিমা প্রধান শিক্ষিকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জড়ো হওয়া লোকজন তাঁকে ধরে স্কুলের সামনেই পিটুনি দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি নিথর হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। তাছলিমার ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
জানা গেছে, আড়াই বছর আগে তাছলিমা বেগম রেনুর সঙ্গে তাঁর স্বামীর তালাক হয়। এ ঘটনার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাঁর ১১ বছরের একটি ছেলে ও চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। ছেলে তাঁর স্বামীর কাছে থাকে। আর মেয়েটি থাকে তাঁর সঙ্গে।
বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় জানান, নিহত তাছলিমা বেগম রেনু মহাখালীতে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পেছনের একটি বাড়িতে ছোট মেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। তিনি কেন বাড্ডা স্কুলে গিয়েছিলেন এ বিষয়ে তাঁর পরিবার কিছু জানাতে পারেনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সাভার (ঢাকা) : সাভারে গতকাল সকালে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। সাভার চামড়া শিল্পনগরী পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক এমারত হোসেন জানান, গতকাল সকালে অজ্ঞাতপরিচয় ওই নারী (৩৫) সাভারের তেতুঁলঝোড়া এলাকায় তেতুঁলঝোড়া কলেজের অদূরে বাসা ভাড়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি বাসায় ঢুকছিলেন। ওই সময় আশপাশের লোকজন তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে আটক করে বেধড়ক মারপিট করে। গণপিটুনিতে ওই নারী মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। খবর পেয়ে সকাল পৌনে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে ওই নারীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। তখন তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। সেখান থেকে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেলে ওই নারী মারা যান।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুরে শুক্রবার রাতে ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে পিটুনি দেয় এলাকাবাসী। এতে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের (২৮) মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত আজিজ (২২) নামের আরেক যুবককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ লাশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক শাহ আলম ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের চান্দর গ্রাম থেকে ধাওয়া খেয়ে দুই যুবক পাশের গ্রাম কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুরে ঢুকে পড়ে। পিছু নেওয়া চান্দর গ্রামের লোকজন রসুলপুরে এসে বলে, যুবক দুজন ছেলেধরা। এ সময় দুই যুবকের জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে তাদের দুই গ্রামের লোকজন মিলে পিটুনি দেয়। খবর পেয়ে হযরতপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আয়নাল হোসেন গিয়ে দুই যুবককে চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান। তাঁদের মধ্যে আজিজ নামের একজনকে ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত অজ্ঞাতপরিচয় যুবককে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে (যুবক) মৃত ঘোষণা করেন।
চাটমোহর (পাবনা) : চাটমোহর উপজেলার বনগ্রাম বাজার এলাকায় গতকাল দুপুরে ছেলেধরা সন্দেহে রাসেল রানা (৩২) নামের একজনকে পিটুনির পর পুলিশে দেয় এলাকাবাসী। রাসেল ঈশ্বরদী উপজেলার আমবাগান এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে।
সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : ছেলেধরা সন্দেহে এলাকাবাসীর পিটুনিতে গতকাল সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিননগরে এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবক (২৫) নিহত এবং মিজমিজি পাইনাদী নতুন মহল্লা পিএমের মোড় এলাকায় শারমিন আক্তার (২০) নামের এক নারী গুরুতর আহত হন। শারমিনকে পুলিশ উদ্ধার করতে গেলে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। উত্তেজিত লোকজন পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ।
এলাকাবাসী, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, আল আমিননগরে মজিবুর রহমান সড়ক দিয়ে সকাল ৮টার দিকে শিশু শ্রেণির এক ছাত্রী (৭) স্কুলে যাচ্ছিল। পথে এক যুবক তার হাতে ধরে জোর করে রিকশায় উঠানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দিয়ে হত্যা করে।
অন্যদিকে সকাল ১০টার দিকে পাইনাদী নতুন মহল্লা শাপলা চত্বর এলাকায় ইতালিপ্রবাসী বিল্লালের বাড়ির চারতলায় খাদিজা বেগম নামের এক নারীর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাঁর নাতিকে (৩) পুতুল দেন শারমিন আক্তার। এ সময় তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে লোকজন পিটুনি দেয়। পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। আহত শারমিন পটুয়াখালীর মরিচবুনিয়া এলাকার সালমান শাহর স্ত্রী। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ঝিলমিল হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা তিনি।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মীর শাহীন শাহ পারভেজ জানান, এ ঘটনায় পুলিশ দুটি মামলা করবে।
গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) : গফরগাঁও উপজেলার দুগাছিয়া মোড় এলাকায় শুক্রবার রাতে ‘গলাকাটা’ সন্দেহে মনোরঞ্জন চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে পিটুনি দেয় স্থানীয় লোকজন। গফরগাঁও থানার পুলিশ রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নেয়। তিনি ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পাইনা গ্রামের অমরণ চন্দ্র বর্মণের ছেলে।
গুজবের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের বিবৃতি
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানার পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রতিটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।