অবশেষে মওসুমের শেষভাগে বরিশালের নদ-নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। শেষ ভাগে হলেও নদীতে ইলিশ ধরা পড়ায় এখানকার জেলেদের মধ্যে ভিন্নরকম ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে। গত এক সপ্তাহ থেকে সাগরের পাশাপাশি নদীর ইলিশ বোঝাই ট্রলার ফিরতে শুরু করেছে বরিশালের ইলিশ মোকামগুলোতে। যে কারণে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে মোকামগুলোতে। সাথে কমেছে মাছের দামও।
বরিশাল জেলা মৎস্য আড়তদার সমিতির প্রচার সম্পাদক ইয়ার উদ্দিন সিকদার জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় হাজার মণ করে ইলিশ আসছে বরিশালের মোকামে। সাগরের পাশাপাশি নদীতে ইলিশ মেলায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি গড়ে ১০ হাজার টাকা কম দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে এক কেজি থেকে ১১ শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৪০ হাজার টাকা। গত এক সপ্তাহ আগে এর দাম ছিল ৫২ হাজার টাকা। ১২ শ’ থেকে সাড়ে ১২ শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা। গত সপ্তাহে তা বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার টাকায়। সূত্রে আরো জানা গেছে, দেড় কেজি ওজনের সবচেয়ে বড় সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৯০ হাজার টাকা দরে। বড় সাইজের এ ইলিশের দেখা সহজে না মিললেও বর্তমানে তা পাওয়া যাচ্ছে। এ সাইজের ইলিশ প্রতি মণে কমেছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও ছয় শ’ থেকে ৯৫০ গ্রাম ইলিশ প্রতি মণ ১০ হাজার টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়। পাঁচ শ’ থেকে ছয় শ’ গ্রাম ইলিশ ২০ থেকে ২২ হাজার ও ছোট সাইজের ইলিশ প্রতি মণ ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট সাইজের এ ইলিশের দামও প্রতি মণে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
জেলেরা জানান, বরিশালের মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কীর্তনখোলা ও সন্ধ্যাসহ বিভিন্ন নদীতে মওসুমের শেষভাগে ইলিশ মিলতে শুরু করায় জেলে পরিবারগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সূত্র মতে, এখানকার জেলেরা সাগরে ইলিশ শিকার করেন না। তারা দীর্ঘ দুই মাস ধারদেনা কিংবা মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে নদী চষে বেড়িয়েও ইলিশের দেখা পাননি। যে কারণে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় এখানকার জেলেদের মধ্যে তেমন কোনো আনন্দ ছিল না। পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদের পোশাক তো দূরের কথা, ভালো খাবারও জোটেনি জেলে পরিবারগুলোতে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে নদীতে ইলিশ মিলতে শুরু করায় জেলে পরিবারের মধ্যে ভিন্নরকম ঈদের আনন্দ ফিরে এসেছে। রোববার সকালে নগরীর পোর্ট রোডের মোকামে বসে জেলে ইউসুফ মাঝি জানান, গত সাত দিনে তিনি প্রচুর ইলিশ বিক্রি করেছেন।
বরিশাল নগরীর নতুন বাজারে বসে কথা হয় ইলিশ ক্রেতা তানভির আহমেদ অভির সাথে। তিনি বলেন, চলতি বছর ইলিশের স্বাদ উপভোগ করতে পারিনি। এত দিন সাগরের ইলিশ ক্রয় করলেও তার স্বাদ নদীর ইলিশের তুলনায় অনেক কম। এবার নদীর ইলিশ কম দামে কিনতে পেরে আমরা মহাখুশি।
চাঁদপুর থেকে ট্রেনে ইলিশ পরিবহন বন্ধ : বিপাকে ব্যবসায়ীরা
শরীফ চৌধুরী চাঁদপুর
চাঁদপুর থেকে ট্রেনে ইলিশসহ সব পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাঁচ বছর অন্য ট্রেনে ইলিশ পরিবহন বন্ধ থাকলেও সাগরিকা এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেনে কিছু ইলিশ মাছ পরিবহন করা হতো, কিন্তু ২০১৫ সালে সাগরিকা এক্সপ্রেস বেসরকারি খাতে যাওয়ার পর সেটিও ইলিশ পরিবহন নিষিদ্ধ করে। এতে করে ট্রেনে ইলিশ পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা ব্যবসায়ীরা অধিক অর্থ ব্যয় করে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ মাছ পাঠানো শুরু করেন। এতে তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। ব্যবসায়ীরা চাঁদপুর থেকে ট্রেনে ইলিশ পরিবহনে অতিরিক্ত বগি সংযোজনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
ইতোমধ্যে ইলিশের ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে চাঁদপুরকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে চাঁদপুরের ইলিশের সুনামও রয়েছে। চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলার জেলেদের ধরা ইলিশ চাঁদপুরের রফতানি কেন্দ্রে এসে স্তূপ করা হয়। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করা হয়। আগে এখান থেকে ট্রেনে ইলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত, কিন্তু বর্তমানে ট্রেনের বগি না থাকায় ট্রেনে আর ইলিশ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা অধিক ভাড়া দিয়ে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করছেন। এতে তাদের ব্যবসা তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। এ ছাড়া সারাদেশে ইলিশের সুষম বণ্টন ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি খালেক মাল জানান, আগে চাঁদপুর থেকে বিভিন্ন জায়গায় অনেক ট্রেন যেত। ইলিশসহ মালামাল নেয়ার বগিও ছিল। বিশেষ করে সিলেটসহ বিভিন্ন মোকামে ইলিশ পাঠানোর জন্য বগি বরাদ্দ থাকত; কিন্তু পাঁচ বছর ধরে ট্রেনে মাছ পরিবহনের কোনো বগি নেই। যার জন্য মাছ পাঠানো যাচ্ছে না। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মালামাল পাঠাতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চাঁদপুর-সিলেট রেলপথে সরকার অন্তত একটি ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি ইলিশের ব্যবসা আরো সম্প্রসারিত হতো।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস গাজী জানান, চাঁদপুর থেকে ইলিশ মাছ বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর জন্য ট্রেনের বগি প্রয়োজন, কিন্তু কোনো বগি নেই। এ জন্য সরকার অনেক টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বগি সংযোজন করলে মাছ ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ পৌঁছাতে পারতেন। শুধু তাই নয় দেশের মানুষ কম দামে ইলিশ খেতে পারত। ব্যবসায়ীদের সুবিধা হতো ও সরকারও লাভবান হতো।
চাঁদপুরের মেসার্স শান্তি ফিসের পরিচালক হাজী আনোয়ার গাজী জানান, চাঁদপুরে ট্রেনে মালামাল পরিবহনের বগি না থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ট্রাকে বিভিন্ন জায়গায় ইলিশ পাঠাতে হয়। যদি আগের মতো ট্রেনে পরিবহনের ব্যবস্থা থাকত তাহলে খুব সহজে বিভিন্ন জেলায় ইলিশ পাঠানো যেত।
বাংলাদেশ রেলওয়ে লাকসামের টিআইটি আবু তাহের জানান, চাঁদপুর স্টেশন থেকে আন্তঃনগর মেঘনা, ডেমু এবং একমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেন সাগরিকা এক্সপ্রেস ছাড়ে। সাগরিকা ট্রেনটি ইতোমধ্যে প্রাইভেট কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। এই ট্রেনে কোনো লাগেজ ভ্যান নেই। যে কারণে চাঁদপুর থেকে ভরা মওসুমে ইলিশ মাছ বুকিং করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি একটা যাত্রীবাহী ট্রেন এবং কমপক্ষে তিনটি লাগেজ ভ্যান সংযোজন করে তাহলে সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ব্যবসায়ীরা ইলিশ মাছ পরিবহনে সুবিধা পাবেন। রেলওয়ের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
চাঁদপুর বড় স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার শোয়েব শিকদার জানান, রেলওয়ে তাদের ইঞ্জিন ও বগি সঙ্কটের কারণে পাঁচ বছর ধরে চাঁদপুর থেকে ইলিশ মাছ পরিবহন বন্ধ রেখেছে। বিষয়টি রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার অবহিত করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছেন যে, ভবিষ্যতে ইঞ্জিন ও বগি সঙ্কট নিরসন করে চাঁদপুর থেকে ইলিশ মাছ পরিবহনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চাঁদপুর বড় স্টেশনের বুকিং ইনচার্জ আবদুস সালাম জানান, বিগত পাঁচ বছর ধরে ট্রেনে ইলিশসহ সব পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকলেও সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে লাকসাম-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ইলিশ মাছ বুকিং দেয়া হতো। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে চাঁদপুর থেকে মাছ ও মালামাল বুকিং দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
ভরা মওসুমে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর রফতানি ঘাট থেকে সারা দেশে ইলিশ সরবরাহের জন্য সরকার ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজনের ব্যবস্থা নেবে এমনটাই দাবি ইলিশ ব্যবসায়ীসহ চাঁদপুরবাসীর।