কমল কান্ত কর্মকার, দিনাজপুর প্রতিনিধি, Smartnews24.com
দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের ২,১৭,২২,৩৭৭ টাকা সরকারী অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। এ ব্যাপারে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আফতাবউদ্দিন মোল্লা গত ১৯/০৪/২০১৬ তারিখে চিরিরবন্দর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে থানার মামলা নং-১৩, জিআর নং-৬৭এর উদ্ভব হয়। মামলাটি বর্তমানে দুদকের তদন্তাধীনে আছে।
মামলাভুক্ত আসামীগণ যথাক্রমে-
১। শ্রী দিলীপ কুমার রায়, পদবী: ষাট-মুদ্রাক্ষরিক,
২। মোছাঃ সুফিয়া আক্তার, পদবী : অফিস সহায়ক,
৩। শ্রী জগবন্ধু দত্ত, পদবী : নিরাপত্তা প্রহরী,
৪। স্বপন কুমার দাস, বহিরাগত নাগরীক।
এই ৪জন আসামী দুদক কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে হাজতে নীত হয়েছেন এবং বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন। মামলায় মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, প্যানেল চেয়ারম্যান আবু হান্নান মোঃ সাদেক ও পরবর্তীকালে দায়িত্বে আসা চেয়ারম্যান মোঃ আফতাব উদ্দিন মোল্লাকে আসামীভুক্ত করা হয় নাই।
সুত্র :চিরিরবন্দর থানার মামলা নং-১৩, জি,আর নং-৬৭/১৬, তারিখ-১৯/০৪/২০১৬ ইং, বর্তমানে দুদকের তদন্তাধীনে।
আত্মসাৎ এর ঘটনাকাল : ২২/০৪/২০১৩ ইং তারিখ হইতে ২৮/০৯/২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত।
ঘটনাকালে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ :
১। UNO মোহাম্মদ মিজানুর রহমান,
২। ভাইস চেয়ারম্যান আবু হান্নান মোঃ সাদেক (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) এবং পরবর্তীতে ২৭/০৩/২০১৪ তারিখ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত,
৩। চেয়ারম্যান মোঃ আফতাব উদ্দিন মোল্লা।
ঘটনা তদন্তে জানা যায়, নবাগত UNO মোঃ ফিরোজ মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তার কাছে উপজেলা পরিষদের হিসাব-নিকাশে গড়মিল পরিলক্ষিত হলে তিনি তার ২৩/০৯/২০১৫ তারিখের স্মারক মাধ্যমে জেলা প্রশাসককে অবগত করেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মোঃ ইমতিয়াজ হোসেন, উপ-পরিচালক, স্থানীয় সরকার, দিনাজপুর ১৪/১০/২০১৫ তারিখ থেকে ঘটনা তদন্ত করেন এবং তিনি ১১/০২/২০১৬ ইং তারিখে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
তার তদন্ত প্রতিবেদনে যা পাওয়া যায়:
১। ১৫/০৪/২০১৩ তারিখ হইতে ২৮/০৯/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১ বছর ৬ মাসে চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের মোট ২,১৭,২২,৩৭৬/৪৫ টাকা সরকারী অর্খ আত্মসাৎ হয়েছে।
২। ১৫/০৪/২০১৩ তারিখ হইতে ১৬/০৬/২০১৪ তারিখ ১৪ মাস সময়কালে উপজেলা পরিষদের নামে জনতা ব্যাংক লিঃ, চিরিরবন্দর শাখায় পরিচালিত হিসাব নং-১০১১০১০১৪০ হতে ১৪টি চেকের মাধ্যমে ৩৫,৪২,৭১২/০০ টাকা উত্তোলন করা হলেও উক্ত টাকা উপজেলা পরিষদের হিসাবের খতিয়ানে নাই, এই টাকা আসামী মোছাঃ সুফিয়া আক্তার ও জগবন্ধু রায় আত্মসাৎ করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, UNO -র স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। তদন্তকালে জনতা ব্যাংক ম্যানেজার মোঃ মাহাবুবর রহমান এর কোন বক্তব্য গ্রহণ করা হয় নাই। ঘটনা তদন্ত শুরুর পুর্বেই UNO মোঃ মিজানুর রহমানকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে লক্ষীপুর জেলায় বদলী করা হয়েছে।
৩। ১২/০৮/২০১৩ তারিখ হতে ২৭/০৭/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের একই হিসাব নং-১০১১০১০১৪০ হতে ৪টি চেকের মাধ্যমে মোট ৭২,৩৬,০৩৮/৭৫ টাকা উত্তোলন করে এবং নগদে প্রাপ্ত ১,৫৩,০০০/- টাকা সহ মোট ৭৩,৮৯,৫৩৮/৭৫ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ভুয়া সৃজিত চালান-কপিতে জমা দেখানোর মাধ্যমে আসামী- শ্রী দিলীপ কুমার রায় ও মোছাঃ সুফিয়া আক্তার উক্ত টাকা আত্মসাৎ করেছেন মর্মে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এবং UNO সাহেব চালানগুলির যথার্থতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করেন নাই মর্মে বলা হয়েছে। কিন্তু ৪টি চেকে এবং ৫টি চালান কপিতে টঘঙ সাহেবের স্বাক্ষর ও সীল যথারীতি বহাল আছে।
৪। ২২/১১/২০১৩ তারিখ হইতে ২৮/০৯/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক লিঃ, চিরিরবন্দর শাখা-য় পরিচালিত উপজেলা পরিষদের চলতি হিসাব নং-০০১০২০০১৭ হতে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে মোট ৭৯,৬৫,৫০০/০০ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন আসামী দিলীপ কুমার রায় ও মোছাঃ সুফিয়া আক্তার মর্মে তদন্তে বলা হয়েছে। উক্ত সময়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন মোঃ ওয়াহেদ আলী ও মোঃ শামীম সরকার। এই অথর্, ব্যাংকে একটি পৃথক হিসাব খুলে উক্ত হিসাবে জমা করার জন্য UNO মোঃ মিজানুর রহমান তার স্বাক্ষরিত ০৬/১০/২০১৩ তারিখের পত্র নং-উনিঅ/চিরির/২০১৩/৪৬৯ মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থাপককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি ২৯/১০/২০১৩ তারিখের পত্র মোতাবেক ১% অর্জনের অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়ার জন্যও চিরিরবন্দর সাব-রেজিষ্ট্রারকে নির্দেশ দেন। UNO মোঃ মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ০৯/০৭/২০১৫ তারিখের পত্র নং-উনিঅ/চিরির/চার-৪৮/২০১৫/৩২২ মাধ্যমে পরিষদের সমস্ত উদ্বৃত্ত অর্থ পরিষদের রাজস্ব তহবীলের চলতি হিসাব নং-১১৭০-এ স্থানান্তর করার জন্য সোনলী ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু এই পত্রে টাকার পরিমান উল্লেখ করেন নাই এবং এই ব্যাংক-হিসাবটি যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হলেও পত্র-জারীর বিষয়ে চেয়ারম্যান মোঃ আফতাব উদ্দিন মোল্লার স্বাক্ষর নাই। এর পরেও বর্ণিত অর্থ আত্মসাৎ এর বিষয়ে দায়ীর সংখ্যা নিয়ে নিশ্চই আরোও কয়েকটি প্রশ্ন নিহীত আছে। তদন্তকালে ব্যাংকের শাখা-ব্যবস্থাপক মোঃ ওয়াহেদ আলী ও মোঃ শামীম সরকার গণের কোন বক্তব্য গ্রহণ করা হয় নাই।
৫। তদন্ত প্রতিবেদন মতে, UNO মোঃ মিজানুর রহমান এর কারনে চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের মোট ১,৮৮,৯৭,৭৫১/-টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। আবু হান্নান মোঃ সাদেক, চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এর দায়িত্বকালে অর্থাৎ ০৩/০৯/২০১৩ তারিখ হতে ২৬/০৩/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত সময়ে তার কারনে পরিষদের চলতি হিসাব নং-০০১০২০০১৭ হইতে মোট ৪২,৬০,০০০/- টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। মোঃ আফতাবউদ্দিন মোল্লা, চেয়ারম্যান এর দায়িত্বকাল ২৭/০৩/২০১৪ তারিখ হতে ২৮/০৯/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত সময়কালে তার কারনে পরিষদের চলতি হিসাব নং-০০১০২০০১৭ হতে মোট ৩৭,০৫,৫০০/- টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।
আইন ও বিধি মোতাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদের সভাপতি। UNO মুখ্য নির্বাহী অফিসার হিসাবে সাচিবিক সহয়তা প্রদান করিবেন। উপজেলা চেয়ারম্যান এবং UNO এর যৌথ স্বাক্ষরে আর্থিক ব্যয় নির্বাহ ও হিসাব-নিকাশ এবং ব্যাংক হিসাব যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে। উপজেলা পরিষদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত যৌথ স্বাক্ষরে পাশ হবে। প্রতি মাসান্তে ব্যাংক হিসাবসমুহের স্টেটম্যান্ট প্রাপ্তি সহ পরিষদের হিসাব নিকাশ সম্পন্ন হবে, প্রতি মাসে জেলা প্রশাসক কর্তৃক কমপক্ষে একবার UNO অফিস অডিট-ইন্সপেকশন হবে। প্রতি মাসে উপজেলা পরিষদের হিসাব-নিকাশের রিটার্ন জেলা প্রশাসক প্রাপ্ত হবেন। ব্যাংক হিসাব থেকে বড় অংকের টাকা উত্তেলনের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপক কর্তৃক ওভার-টেলিফোনে কনফারমেশন এর নিয়ম চালু আছে।
ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনা-কালে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন আহম্মদ শামীম আল-রাজী। এই জেলা প্রশাসক ছিলেন ঘুষখোর এবং অপরাধ-প্রবণ ব্যক্তি, তিনি UNO থেকে তহসীলদার পর্যন্ত সকলের নিকট থেকে বে-পরোয়া ঘুষ নিতেন এবং নানান বে-আইনী ও এখতিয়ার বহির্ভুত কাজ করতেন ও করাতেন এবং উচ্চ পর্যায়ে তার খুটির জোর খুব শক্ত ছিল। আহম্মদ শামীম আল-রাজী মোটা অংকের টাকা ঘুষ গ্রহণ করার মাধ্যমে সরকারী সম্পত্তির দাবীতে ঘোড়াঘাট উপজেলায় ২ জন নাগরীক যথাক্রম:
১। প্রদীপ কুমার সরকার ও ২। সৈয়দ আঃ হাকিম এর বাড়ীঘর বে-আইনীভাবে ভেঙ্গে দিয়ে তাদেরকে নিস্ব করে দেন। ঐ বাড়ী ভাঙ্গা ঘটনার বিরুদ্ধে সেই সময়ে জেলা প্রশাসক আহম্মদ শামীম আল-রাজী, ২জন এসি-ল্যান্ড, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটট, ইউনিয়ন তহসীলদার সহ সংশ্লিষ্ট মোট ৬ জনকে আসামী করে বাংলাদেশ দন্ডবিধি-র ১৪৩/২১৯/২৯৫/৪৪৮/৪২৭/৩৮০/৩৮৫/৩৮৬/৫০৬/১১৪/৩৪ ধারার আওতায় দিনাজপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ২টি ফৌজদারী মামলা দায়ের হয়।
আরোও জানা যায়, চিরিরবন্দর উপজেলা কার্যালয়ের অফিস-সহায়ক মোছাঃ সুফিয়া আক্তার এর সাথে চিরিরবন্দর UNO মোঃ মিজানুর রহমান এর সু-সম্পর্ক ছিল, UNO -র সাথে জেলা প্রশাসক আহম্মদ শামীম আল-রাজী এর সু-সম্পর্ক ছিল। পরিষদের আত্মসাৎকৃত অর্থের অংশ UNO মোঃ মিজানুর রহমান এর পকেটে ঢুকেছে এবং জেলা প্রশাসক আহম্মদ শামীম আল-রাজীর পকেটে গেছে মর্মে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারন আছে। এই নির্বাহীরা “পানি নিচের দিকে গড়ায়” নীতিতে টিকে আছেন। ব্যাংক ব্যবস্থাপকগণের জবাবদীহিতা আইনগতভাবে আবশ্যক ছিল।
ঘটনার ধারাবাহিকতা ও বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন মতে, চিরিরবন্দর UNO মোঃ মিজানুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু হান্নান মোঃ সাদেক এবং পরবর্তীতে ২৭/০৩/২০১৪ তারিখ হতে দালিত্বে বহাল চেয়ারম্যান মোঃ আফতাব উদ্দিন মোল্লা এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপক গণের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি স্পষ্টত: প্রতীয়মান হইয়াছে এবং এখানে ব্যাংকের সহায়তায় মানি-লন্ডারিং এর অপরাধও সংঘটিত হইয়াছে। মামলাটি তথ্য গোপন করার মাধ্যমে যোগসাজসীভাবে দায়ের করা হইয়াছে। সুতরাং অভিযুক্তত কর্মচারীগণের সাখে টঘঙ, চেয়ারম্যানদ্বয় ও ব্যাংক ব্যবস্থাপকগণকেও দুর্নীতির মামলায় আসামীভুক্ত করার আবশ্যকতা ছিল।
এব্যাপারে চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন মোল্লা এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে হলে তিনি জনান যে, UNO মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবু হান্নান মোঃ সাদেক (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) গণকে আসামীভুক্ত করার জন্য সরকারের অনুমতি ইতিমধ্যে মন্ত্রনালয় হইতে পাওয়া গিয়াছে। কোন অপরাধীই আইনের উর্ধে থাকতে পারে না। ফৌজদারী মামলা দায়েরে ত্রুটি করা হলে বিজ্ঞ আদালতে ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা থাকে। এখানে ঘটনা কালের পুর্বে দুর্নীত হয়েছে, ঘটনাকালে দুর্নীতি হয়েেেছ এবং ঘটনার পরবর্তীকালে মামলা দায়ের করা নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে।