1. ‘আমি দেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছি শুধু বাংলাদেশের খেলা দেখতে।’
খোরশেদ মাদবর আলমগীরের কথাটা প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবিশ্বাসটা ধরতে পেরে ভদ্রলোক বললেন, ‘খেলা শেষ হলে আবার দেশে ফিরে যাব। বাংলাদেশের খেলা হলে আমি আর থাকতে পারি না।’
এরপর তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলী হতেই হয়। বাংলাদেশ থেকে এত দূরে খেলা দেখতে চলে এসেছেন! খরচ দিচ্ছে কে?
আলমগীর: আমি নিজেই। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে বাংলাদেশের সিরিজ দেখি। বিদেশে গিয়ে খেলা দেখার সেই শুরু। এরপর থাইল্যান্ডে গিয়ে মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব দেখেছি। ভারতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, হায়দরাবাদ টেস্ট, শ্রীলঙ্কায় সর্বশেষ বাংলাদেশ দলের সিরিজ—সব জায়গায় গিয়েছি।
* কেন এটা করেন? আপনার তো অনেক টাকা খরচ হয়!
আলমগীর: ছোটবেলা থেকেই আমি খেলার পাগল। মাঠে এসে খেলা না দেখলে ভালো লাগে না।
৩৮ বছর বয়সী আলমগীরের বাড়ি ঢাকার আশুলিয়ায়। সেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। বাংলাদেশ দলের একটি সমর্থক গোষ্ঠীর সদস্য তিনি। তবে খেলা দেখতে বিদেশে যান নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। নেশা বলে কথা! ভালোবাসাও কি নয়?
২.
কেপ পয়েন্ট ঘুরতে গিয়ে দেখা মারুফ সাহেবের সঙ্গে। স্ত্রী, দুই বন্ধুসহ তিনি এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে। পর্যটকদের ভিড়ের মধ্যে বাংলা কথা শুনেই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া। মারুফ সাহেব পরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও বন্ধুদের সঙ্গেও। খোরশেদ মাদবর আলমগীরের মতো তাঁদেরও দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার উদ্দেশ্য বাংলাদেশ দলের খেলা দেখা। এর আগে অন্যান্য দেশে গিয়েও বাংলাদেশের খেলা দেখেছেন মারুফ দম্পতি। ‘আমাদের উদ্দেশ্য একটাই—বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দেওয়া। আর কিছু না।’ মাশরাফি-সাকিবদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশটা এভাবেই করলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মারুফ।
বাংলাদেশের ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের প্রতি এ রকম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পৃথিবীময়ই ছড়িয়ে আছে। ক্রিকেটাররাও তাঁদের কম দিচ্ছেন না। প্রবাসীরাই বলেন, বিদেশের মাটিতে তাঁরা মাথাটা উঁচু রাখতে পারেন ক্রিকেটাররা ওই এক-দুইটা জয় পান বলেই। কিন্তু এবার? টেস্টের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাল ওয়ানডে সিরিজটাও বাংলাদেশ শেষ করল হতাশার সাগরে ডুবে গিয়ে। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকেই ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে ধরা হচ্ছে নতুন শক্তি। কিন্তু এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় কোথায় হারাল সেই শক্তি? বাংলাদেশ তো একটি ম্যাচেও প্রতিরোধ গড়তে পারল না! যে উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা রানের বন্যা বইয়ে দিলেন, সেখানেই কেন একের পর এক ম্যাচে রচিত হলো বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের বধ্যভূমি! আর কত এমন হতাশা-জাগানিয়া ক্রিকেট!
ওয়ানডে সিরিজটা যত এগিয়েছে, ততই যেন রং হারিয়েছে গত দুই বছরে অর্জিত গৌরব। তিনটি ম্যাচে এমন একটা মুহূর্তও আসেনি, যেখানে বাংলাদেশের সমর্থকেরা আশাবাদী হতে পেরেছেন। এমন একটা মুহূর্ত আসেনি, যেটাকে আঁকড়ে ধরে বাংলাদেশ দল বলতে পারে, ওই সময়টায় আমরা ভালো খেলেছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরজুড়েই শুধু ‘নেই, নেই আর নেই’-এর হাহাকার।
সবচেয়ে দুর্দশা গেছে বোলারদের। কিম্বার্লিতে মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরি স্কোরবোর্ডে ২৭৮ রান এনে দিলেও বোলাররা দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনিং জুটিটা পর্যন্ত ভাঙতে পারেননি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তো এক এবি ডি ভিলিয়ার্সই ধ্বংস করে দিলেন সবকিছু। ৩৫৩ রানের জবাবে কী করবে বাংলাদেশ! কাল ইস্ট লন্ডনের শেষ ওয়ানডেতে তো আরও খারাপ অবস্থা। কারও সেঞ্চুরি ছাড়াই দক্ষিণ আফ্রিকা করে ফেলল বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের সর্বোচ্চ রান—৩৬৯। সেখান থেকে ২০০ রানের হার। সফরটা যেন শেষ হলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বেঁচে যান।
উপায় নেই। ওয়ানডে সিরিজ শেষ হলেও বাকি আছে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটীয় অত্যাচার তাই আরেকটু সহ্য করতেই হচ্ছে। তবে আলমগীর, মারুফদের মতো নিঃস্বার্থ সমর্থকেরা আশা হারান না। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তাঁরা আবারও মাঠে যাবেন। চিৎকার করে উৎসাহ দেবেন। ভালোবাসা বলে কথা!