জাদুকর তাঁর রহস্যময় হ্যাট থেকে আসল বিস্ময়টা বের করে আনলেন একেবারে প্রদর্শনীর শেষে। পুরো পাহাড় বোঝা একা বয়ে নিলেন কাঁধে। লিওনেল মেসি, আর্জেন্টিনার গায়ে তাঁর সম্ভাব্য শেষ ম্যাচ খেলতে নেমে গড়লেন নতুন ইতিহাস। ছাইভস্ম থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখি। মেসির দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ইকুয়েডরকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সরাসরি বিশ্বকাপ নিশ্চিত করল আর্জেন্টিনা।
ড্র করলেও হয়তো বাদ পড়ে যেতে হবে, জিতলেও সরাসরি নিশ্চিত নয় বিশ্বকাপ—এমন কঠিন সমীকরণ ছিল আর্জেন্টিনার সামনে। ছিল ইকুয়েডরের পর্বতচূড়ায় খেলার কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। যেখানে আর্জেন্টিনার সর্বশেষ জয় ছিল ১৬ বছর আগে। পুরো পর্বতমালা আর্জেন্টিনার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ম্যাচের মাত্র ৪০ সেকেন্ডে গোল করল ইকুয়েডর! আর্জেন্টিনা তখন ১৯৭০ বিশ্বকাপের পর প্রথম বাছাইপর্বে ছিটকে যাওয়ার ফাঁদে।
মেসির দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ইকুয়েডরকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সরাসরি বিশ্বকাপ নিশ্চিত করল আর্জেন্টিনা। ছবি: এএফপিএই অবস্থায় দ্রুত গোল না পেলে মানসিকভাবেই ভেঙে পড়ত আর্জেন্টিনা। বলের অস্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ইকুয়েডর পাল্টা আক্রমণে আরও কয়েকবার ত্রাসও ছড়াল। সেই চাপ থেকে দলকে বের করে আনতে জাদুকরি কিছু একটা করতেই হতো মেসিকে। মেসি পারবেন? নাকি রাশিয়া বিশ্বকাপটা মেসিকে ছাড়াই দেখতে হবে? ভাষ্যকারের গলাও তখন কাঁপছে।
১২ মিনিটে জন্ম নিল প্রথম জাদুকরি মুহূর্তটি। ড্রিবল করে বল বাড়ালেন বাঁ প্রান্তে থাকে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া দিকে। দারুণ বোঝাপড়ায় ওয়ান-টু। ডি মারিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া বলে বক্সের ভেতর থেকে সেই চেনা বাঁ পায়ের শট। উদ্যাপন করার সময় অতটা নেই। বল নিজেই জাল থেকে কুড়িয়ে বসালেন সেন্টারে।
২০ মিনিটে এবার মেসির একার জাদু। ইকুয়েডর ডিফেন্ডারের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে বক্সের বা প্রান্তে ঢুকে জোরালো কিন্তু মাপা শটে ক্রসবারের নিচ দিয়ে পাঠালেন জালে। ২-১!
এগিয়ে থাকলেও স্বস্তিতে নেই আর্জেন্টিনা। অন্তত ২ গোলের লিড তো চাই। সেটাও এনেই দিয়েছিলেন প্রায়। ৩২ মিনিটে দুর্দান্ত থ্রু বল। ডি মারিয়া রক্ষণের ফাঁদ গলে বেরিয়েও গেলেন। সামনে কেবল গোলরক্ষক। কিন্তু বলটা চিপ করতে পারলেন না ডি মারিয়া।
প্রথমার্ধ সেখানেই শেষ। কিন্তু পর্বতচূড়ার অক্সিজেনের ঘাটতি ৬০ মিনিটের ক্লান্তি এনে দিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ইকুয়েডর আরও গোছালো আক্রমণ শুরু করল। ২-২ ড্র হলেও বিপদে পড়বে আর্জেন্টিনা। এবার ৬২ মিনিটে বক্সের মাথায় বল পেয়ে তিন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে বল ভাসালেন হাওয়ায়। বোকা বনে গেলেন লাইন থেকে বেশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্রস্তুত গোলরক্ষক। হ্যাটট্রিক! বার্সেলোনার জার্সিতে ৩৯টি হ্যাটট্রিক করেছেন। আর্জেন্টিনার জার্সিতেও চারটি। কিন্তু ক্যারিয়ারের ৪৪তম হ্যাটট্রিকটি মেসি ভুলবেন না কখনো।
বদলি হিসেবে নামা ইকার্দি যোগ করা সময়ে সহজ সুযোগ হাতছাড়া না করলে ব্যবধান বড় হতে পারত। নতুন তারকা দিবালা মাঠে নামার সুযোগই পেলেন না। না হয়ে ভালো হলো বরং। ম্যাচটি পরিপূর্ণভাবে হয়ে গেল মেসি শো। আজকের দিনের জন্য মেসি একাই যেন হ্যারি হুডিনি, নয়তো ডেভিড কপারফিল্ড। যেদিন মেসির নিন্দুকেরাও মুখে যা-ই বলুন, মন থেকে প্রবল করতালি দিয়ে বলছেন, ব্রাভো, ব্রাভো!
স্বপ্নভঙ্গের আতঙ্ক পেয়ে বসেছিল আর্জেন্টিনাকে। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে এসেও যে প্রশ্নটা ঝুলে ছিল—রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ মিলবে তো?
দেশের এমন ভীষণ প্রয়োজনের মুহূর্তে লিওনেল মেসিকে দেখা গেল স্বরূপে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নয় হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত কিটোয় একাই লড়ে মেসি বিশ্বকাপের টিকিট পাইয়ে দিলেন আর্জেন্টিনাকে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শুধু সত্যিকারের কিংবদন্তিরাই ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। বার্সেলোনার জার্সিতে মেসির এ কথা প্রমাণের কিছু নেই; যদি থেকে থাকে সেটা জাতীয় দলের জার্সিতে। কিটোয় মেসির হ্যাটট্রিকের পর হয়তো সে প্রয়োজন ফুরোল। একটা দেশকে একাই বিশ্বকাপে টেনে নেওয়ার উদাহরণ যে খুব বেশি নেই!
হ্যাটট্রিক করে দেশকে বিশ্বকাপে তুললেন মেসি। এমন আনন্দ তাঁকেই মানায়। ছবি: এএফপি২০১৮ বিশ্বকাপের প্লে অফ নিশ্চিতে ইকুয়েডরের বিপক্ষে জিততেই হবে—এমন সমীকরণ মাথায় নিয়ে মাঠে নেমে খেলা শুরুর ১ মিনিটেই পিছিয়ে পড়েছিল আর্জেন্টিনা। সেখান থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আর্জেন্টিনা ম্যাচে এগিয়ে যায় ২-১ ব্যবধানে। ১২ মিনিটে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার ক্রস থেকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান মেসি। এর ৮ মিনিট পর দুর্দান্ত এক দৌড়ে মেসি ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেন ইকুয়েডর রক্ষণভাগকে। বাঁ প্রান্ত থেকে চকিত শটে মেসির গোলটি রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগ পর্যন্ত স্বস্তি দেবে গোটা আর্জেন্টিনাকে। লাতিন আমেরিকান বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এটা ছিল মেসির ২০তম গোল। মহাদেশটির বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি এখন মেসির।
৩২ মিনিটে মেসির ডিফেন্সচেরা থ্রু থেকে জয়ের ব্যবধান ৩-১ করতে পারত আর্জেন্টিনা, যদি ডি মারিয়া ব্যর্থ না হতেন। তবে ম্যাচের স্কোরলাইনটা শেষ পর্যন্ত ওটাই থেকেছে, সেটাও মেসির অনিন্দ্যসুন্দর গোলের কল্যাণে। প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে সতীর্থের পাস বুক দিয়ে নামালেন মেসি। বলটা সামনে পড়ল তাঁর বাধ্যগত ছাত্রের মতো! সামনে ইকুয়েডরের তিন ডিফেন্ডার। রোজারিও নদীর বহতা স্রোতের মতো তাঁদের এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে টপকে গেলেন মেসি। এরপর গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে তাঁর সেই চিরাচরিত মসৃণ ‘লব’ এবং গোল! দেশের জার্সিতে এটা ছিল মেসির পঞ্চম হ্যাটট্রিক। সব মিলিয়ে ৪৪তম ক্যারিয়ার হ্যাটট্রিক!
চলতি বছর ক্লাব ও দেশের হয়ে মোট ৪৯ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যাও ৪৯। এমনিতেই তাঁর গোটা ক্যারিয়ারই গোল দিয়ে সাজানো। কিন্তু আজকের হ্যাটট্রিক ছিল অন্য রকম, বলতে পারেন একধরনের বার্তাও—মেসি শুধুই বার্সার নয়, আর্জেন্টিনারও!