সুপারি চিবিয়ে কষ কষ মুখে কী যে সুখ, তা তাঁরাই জানেন। এতে দাঁতের চেহারা তো বদলে যায়ই, পিচিক করে মারা মুখের রস যেখানটায় পড়ে, এর রংটাও আর দর্শনযোগ্য থাকে না।
এ দৃশ্য পাপুয়া নিউগিনির। এখানে সুপারির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুখের ক্যানসারও। আর এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে দেশটির সরকারকে। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় বুয়াই।
পাপুয়া নিউগিনির লোকজনের বেশির ভাগেরই জীবন চলে সুপারি বিক্রি করে। স্থানীয়ভাবে জাতীয় এই অর্থকরী উপাদানকে ‘সবুজ সোনা’ বলা হয়। এটি পুরোপুরি করমুক্ত। স্থান, কাল ও চাহিদা অনুযায়ী একটি সুপারি ও সরষের স্টিক ৬ সেন্টস থেকে দেড় ডলারে বিক্রি হয়।
ইস্ট নিউ ব্রিটেন প্রদেশে বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসবে সবখানেই দেখা গেল, সবাই আচ্ছা করে সুপারি চিবোচ্ছে। সেখানে বাইনিং পাহাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ফিলোমেনা নামের এক নারী। সন্তানদের মধ্যে ছোটটির বয়স ৮ আর বড়টির বয়স ১৮। প্রত্যেকেই সুপারি চিবোচ্ছে।
ফিলোমেনা বলেন, ‘এটি শরীরকে চাঙা করে তোলে। আপনার মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি তৈরি করবে আর আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে তা কাটিয়ে দেবে।’ তাঁর ১৮ বছরের মেয়ে সোফিয়া বলেন, ১০ বয়স থেকে তিনি সুপারি খান। বলেন, ‘সুপারি আমাকে সুখ দেয়। বুয়াই ছাড়া আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, ঘুম ঘুম লাগে। এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ।’
সুপারিতে যে উপাদান রয়েছে, তা মস্তিষ্কে অনেকটা নিকোটিনের মতো কাজ করে। এটি স্নায়ুতে প্রভাব সৃষ্টি করে এবং ক্যানসারের কারণ ঘটায়। বিশ্বে পাপুয়া নিউগিনিতে মুখের ক্যানসারের হার সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, মুখের ক্যানসারের নতুন ৫০০টি ঘটনার মধ্যে একটি পাপুয়া নিউগিনির। আর ক্যানসারের মধ্যে মুখের ক্যানসারেই পাপুয়া নিউগিনির মানুষ বেশি মারা যায়।
ওয়েস্ট নিউ ব্রিটেনের কিমবে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ইভোন সাপুরি। তিনি প্রতি সপ্তাহে মুখের ক্যানসারের অন্তত দুটি নতুন রোগী পান। তিনি বলেন, ‘এ সংখ্যা বাস্তবের চেয়ে অনেক কম। আমাদের যে তথ্য রয়েছে, তা নির্ভুল নয়। এমন অনেক রোগী শনাক্তই হয় না।’
এই দেশে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ খুবই সীমিত। এখানে প্রায়ই ওষুধের সংকট। নেই তেমন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। পাপুয়া নিউগিনিতে ক্যানসারের জন্য বিশেষায়িত মাত্র একটি হাসপাতাল রয়েছে। একজন মাত্র রেডিয়েশন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। গত বছর তিনি চাকরি ছাড়ার পর থেকে এখন রেডিওথেরাপি বন্ধ রয়েছে।
রাস্তার পাশে ছোট্ট দোকানে সুপারি, সরষে ও কলা বিক্রি করেন উইনিফ্রেড। নিজের বাড়ির পেছনেই চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, এটা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। কিন্তু এটি ছাড়া থাকতে পারি না। বাড়ির পেছনের উঠানে খুব সহজেই এটি জন্মে। আমাদের শুধু জানতে হবে, কতটুকু খাওয়া যাবে।’
চার সন্তানের এই জননী বলেন, ‘আমার সন্তানেরা যখন সাত কি আট বছরের, তখন থেকেই তারা শিখে গেছে কীভাবে সুপারি চিবোতে হয়। আমি তাদের থামাতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। আমাদের সন্তানদের সুপারি না খেতে শেখাতে হবে।’
পোর্ট মোজবে জেনারেল হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিভাগের সার্জন পাকি মৌলুমি বলেন, খুব অল্প বয়সে যদি একটি শিশু সুপারি চিবোতে শেখে, তাহলে ৩০ বছরের আগেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয় সে।
রাজধানী পোর্ট মোজবে সুপারি বিক্রি ও কেনার ওপর সাড়ে তিন বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। রাজধানীতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ কিনার (মুদ্রা) সুপারি বেচাকেনা হতো। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রদূত ছিলেন সিটির গভর্নর পাওস পার্কার। অনেকে এ সিদ্ধান্তকে তাঁর জন্য ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বলে মনে করেন। সম্প্রতি দেশটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। তাই এ নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে অনুমোদিত কয়েকটি জায়গায় সুপারি বিক্রি করা যাবে।
ওয়েস্ট নিউ ব্রিটেনের কিমবে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ইভোন সাপুরি বলেন, ‘বেশির ভাগ রোগী অনেক দেরিতে হাসপাতালের শরণাপন্ন হন। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা নড়বড়ে। ক্যানসার চিকিৎসা পুরোপুরি সচল নয়; তাই এর থেকে বাঁচার হার খুব কম। সুপারির জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ক্যানসার রোগীর চাপে ভবিষ্যতে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিদীর্ণ হওয়ার জন্য টাইমবোমার মতো টিক টিক করছে।’
আগের চেয়ে এখন বেশি মানুষ সুপারি খায়। সবাই জানে, এটি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ; এরপরও লোকজন আসক্তির কারণে খেয়েই চলেছে। এটা অনেকটা চা খাওয়ার মতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে তা ভয়ানক একটা বদঅভ্যাসই বটে!