প্রতিদিনের চলার পথে এখানে-সেখানে তার শুধু চোখ আটকে যায়। যেদিকে তাকায়, সেখানেই গাদা গাদা ময়লা-আবর্জনা, বিশেষ করে রংবেরঙের প্লাস্টিকের ব্যাগ। এসব দেখে মন খারাপ হয়ে যায় তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, এ কী অবস্থা তার নিজের শহরের। শুধু যে এ জন্যই মন খারাপ হয় তা নয়, তার মতো বয়সী অনাথ সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে দেখেও মন কাঁদে তার। কী করবে ভেবে উঠতে পারে না এই শিশুমন। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে, এই তাগিদ তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
যার কথা বলছি, তার নাম জাইমাল ওমার। এখন তার বয়স ১০ বছর। পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সারগোধার বাসিন্দা। যখন তার বয়স ছয়, তখন একদিন সে তার মায়ের সঙ্গে বাজার থেকে ফিরছিল। দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে সে জানায়, ‘তখন দেখি, এক দোকানি পত্রিকার কাগজ দিয়ে তৈরি ব্যাগে খরিদদারকে জিনিসপত্র দিচ্ছে, বিষয়টি মাথায় গেঁথে যায়।’ সেখান থেকেই প্লাস্টিকের হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে সিদ্ধান্ত নেয় সে।
জাইমালের বানানো ব্যাগ। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়াপাকিস্তানের পরিবেশ সুরক্ষা বিভাগের হিসাবে, দেশটিতে প্রতিবছর ২০ মেট্রিকটন কঠিন বর্জ্য জমা হয়। আর প্রতিবছর তা ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর এসব আবর্জনা পোড়ানোর পর বিষবাষ্পে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।
বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে জাইমাল বলে, ‘এ অবস্থা পাকিস্তানের সর্বত্র। এসব ব্যাগ নষ্ট হয় না। লোকজন হেলাফেলায় এসব ফেলে যায়। তারা কখনো পুনর্ব্যবহার নিয়ে ভাবে না।’
সৌদি আরব থেকে পায় প্রিন্স আবদুল আজিজ অ্যাওয়ার্ড। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়াতাই জাইমাল বাড়ি ফিরেই মনস্থির করে, সেও ঘরের পুরোনো পত্রিকার কাগজ দিয়ে বাজারের ব্যাগ বানাবে। কিন্তু কীভাবে বানাতে হয়, তা সে জানে না। নো চিন্তা। আছে সবজান্তা স্কুল ইউটিউব। সে ইউটিউব থেকে শিখে নেয়, কীভাবে তৈরি করতে হয় ব্যাগ। পুরোনো পত্রিকার কাগজ দিয়ে ব্যাগ তৈরি করে কোনোটির ওপর পাথর বসিয়ে, কোনোটির ওপর বোতাম দিয়ে আবার কোনোটির ওপর কৃত্রিম ফুল বসিয়ে তৈরি করে সুন্দর সুন্দর ব্যাগ। প্রথম ব্যাগটি সে বিক্রি করেছিল তার চাচাতো বোনের কাছে। প্রথম দিকে তার ব্যাগগুলো আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা কিনে নিত।
বিবিসি অনলাইনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাইমাল বলে, ‘আমার বাবা ও দাদা আমাকে ব্যাগ বানানোর কাঁচামাল কেনার রুপি দেন। তাঁরা সাহায্য না করলে আমার পক্ষে এটা চালু রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ত।’
শিশুপল্লিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে গত বছর নতুন কাপড় বিতরণের পর তাদের সঙ্গে জাইমাল। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়াগত তিন বছরে জাইমাল প্রতিটি ব্যাগ ১০০ রুপি করে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ডলার আয় করেছে। প্রথম দিকে জাইমাল তার আয় করা অর্থ সানা নামের এক অনাথ শিশুকে দিয়ে সহায়তা করে। এরপর সে আরও বড় পরিসরে কিছু করার কথা ভাবে। এ অর্থ দিয়ে দেয় এসএএস (সেভ আওয়ার সোলস) শিশুপল্লিতে। সেখানে অনাথ ও নিঃস্ব শিশুদের জন্য এ অর্থ ব্যয় হয়।
জাইমাল বলে, ‘আমার উপার্জন দিয়ে জলরং, ওয়াশিং মেশিন, ব্যাটারি আর দৈনন্দিন জীবনে যা লাগে, তেমন কিছু কিনতে পারি। এগুলো পেয়ে তাদের চোখে-মুখে যে আনন্দ ফুটে ওঠে, তা দেখে আমি তৃপ্তি পাই এবং আরও কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই।’
পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যাগ তৈরির কাজ করতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয় জাইমালকে। তার ভাষ্য, ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এবং অন্যান্য ছুটিতে চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে এখন ব্যাগ বানাই।’
পাকিস্তানের রাস্তাঘাটের আশপাশে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়াখুদে এই বড় মনের মানুষের কর্মকাণ্ড দেশটির গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। পাকিস্তানের ‘কনিষ্ঠ সামাজিক উদ্যোক্তা’র পুরস্কার পায় সে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষাসচিবের কাছ থেকে পায় স্বর্ণপদক। শুধু নিজের দেশেই নয়, তার এই উদ্যোগ সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সৌদি আরব থেকে পায় প্রিন্স আবদুল আজিজ অ্যাওয়ার্ড ফর চিলড্রেন পাইওনিয়ার/ইকোপ্রিনার পুরস্কার।
জাইমালের স্বপ্ন সে তার শহর সারগোধাকে সবুজ নগরে পরিণত করবে। সে চায়, তার এই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ দুইভাবে কাজে আসবে। একদিকে এর মধ্য দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে, অন্যদিকে প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্য দিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, তা কমবে। তবে জাইমাল তার স্বপ্ন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। সে মনে করে, তার এই সাফল্য অন্যদের মনকে নাড়া দেবে। তারাও পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখবে।
জাইমাল বলে, ‘আমি বলতে চাই, আমি আমারটুকু করছি, আপনি করছেন তো?’