রাজধানীর দুয়ারিপাড়ার ৫ নম্বর লেনের মানুষের বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। তাঁরা ভাবতেও পারছেন না শামীমের মতো গোবেচারা কেউ বন্ধুর লাশ নিজের ঘরের চৌকির নিচে পুঁতে রাখতে পারেন। গত শুক্রবার শামীম নিজেই পুলিশের উপস্থিতিতে চার ফুট মাটি খুঁড়ে তাঁর আট বছরের পুরোনো বন্ধু কালামের হাড়গোড় বের করে দেন।
দুয়ারিপাড়ায় সারি বেঁধে ওঠানো ঘরগুলোর যেটিতে শামীম থাকতেন, তার আশপাশে ১০টির মতো ঘর আছে। সবাই শ্রমজীবী। ওই জায়গাটি আগে ডোবা ছিল। মাটি ফেলে উঁচু করে ঘর তোলা হয়েছে বছর দুয়েক আগে। গতকাল শনিবার দুয়ারিপাড়ায় শামীমদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শামীম খুব লাজুক আর অন্তর্মুখী। বাবা-মাকে নিয়ে এই ঘরে উঠেছিলেন ২০১৫ সালের শেষ দিকে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে শামীমের মা ও পরে বাবা ঢাকা ছেড়ে পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এরপর থেকে শামীম একাই ছিলেন বাসায়। একটি দরজির দোকানে কাজ করতেন। পরে আখের রস বিক্রি করতে শুরু করেন। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে প্রতিবেশীদের বলেন, তাঁর দাদি অসুস্থ। তিনি বাড়ি যাচ্ছেন। কিছুদিন পরই ফিরে আসবেন। মালপত্র রেখে তিনি চলে যান। কোহিনূর বেগম নামে তাঁর এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, মাস দুয়েক আগে এক যুবক এসে তাঁদের শামীমের ছবি দেখান। তিনি কোথায় আছেন সে সম্পর্কে খোঁজখবর করেন। তিনি বলেন, কালামের মুঠোফোন শামীমের কাছে রয়েছে। কালামকে কয়েক মাস ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘটনাটির তদন্ত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদৎ হোসেন বলেন, তাঁরাও এই মুঠোফোনের সূত্র ধরেই শামীমকে খুঁজে বের করেন। কালাম নিখোঁজ হন গত ১৩ এপ্রিল। এক দিন পরই কালামের ভাই বাশার রূপনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে বেরিয়ে আসে, পটুয়াখালীর শামীম নামের একজন কালামের ফোনটি ব্যবহার করছেন। পুলিশ পটুয়াখালীতে শামীমের সন্ধান পায়। শামীম বলেন, দুই হাজার টাকায় কালাম মুঠোফোনটি তাঁর কাছে বিক্রি করেছেন। এটুকু বলে তিনি পুলিশকে অপেক্ষা করতে বলে পালিয়ে যান। মাস দুয়েক আগে বাশার রূপনগর থানায় শামীম ও তাঁর বাবার নামে অপহরণ মামলা করেন। পুলিশ শামীমের বাবাকে গ্রেপ্তার করে। ২৬ অক্টোবর তারা শামীমকেও গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে শামীম এই হত্যার কথা স্বীকার করেন। তবে লাশ খুঁজে পেতে আবারও কৌশলের আশ্রয় নেন তিনি। শামীম বলেন, কালামকে তিনি, তাঁর এক বন্ধু স্বাধীন ও আরও দুজন মিলে ঘাড়ের পেছনে কোপ দিয়ে খুন করেছেন। ১৩ এপ্রিল কালামকে তাঁরা মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যান। তারপর একটি পুকুরের কাছে ঘাড়ের পেছনে কোপ দিয়ে হত্যা করেন। লাশটি পুকুরেই রয়েছে। ২৭ অক্টোবর দিনভর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা পুকুরে লাশ খোঁজেন। কিন্তু সন্ধান পাননি। পরে শামীম স্বীকার করেন, হত্যার পর ডালপালা দিয়ে প্রথমে কালামের লাশ তাঁরা ঢেকে রেখেছিলেন। পরে ধরা পড়ে যেতে পারেন—এই আশঙ্কায় তাঁরা একটি ভ্যানে করে লাশ রূপনগরে নিয়ে আসেন। চৌকির নিচের মাটি খুঁড়ে সেখানেই পুঁতে ফেলেন কালামকে।
বন্ধুকে কেন শামীম খুন করলেন? এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদৎ হোসেন বলেন, কালামের প্রেমিকাকে শামীম ভালোবেসে ফেলেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে বাগে আনতে পারছিলেন না। এদিকে গ্রিল মিস্ত্রি কালাম তাঁর সহকর্মী স্বাধীনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। ফেরত দিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল স্বাধীনের। পরে শামীম ও স্বাধীন জোট বেঁধে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন কালামকে। খুনে জড়িত অপর দুজনকে এখনো পুলিশ খুঁজছে।
গতকাল দুয়ারিপাড়ায় ওই ঘরটিকে ঘিরে বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। যে গর্ত থেকে হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়, সেখানে পানি উঠেছে। একজন মানুষকে পুঁতে ফেলা হলো, তারপরও তাঁরা কিছু বুঝতে পারেননি কেন—এমন প্রশ্নে প্রতিবেশীরা বলেন, প্রায়ই এমন ব্যাগে করে শামীম ও তাঁর বাবা জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। তা ছাড়া আচার-আচরণও ছিল খুব স্বাভাবিক। ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় কিছুই নেননি। গতকালও শামীমের ভাড়া ঘরে তাঁর কাপড়চোপড়, কাঁথা ঝুলতে দেখা গেছে। ঘরের আড়ায় বস্তায় ছিল থরে থরে জিনিস, এক কোনায় একটি আয়না। কৌতূহলের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের মনে এখন ভয়। ঘরের সামনে মায়ের কোল ঘেঁষে ভ্যানে বসেছিল সাবিনা আক্তার। সাবিনার মা লাইজু প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা রাত মাইয়া ঘুমায় নাই। বড়রাই ঘুমাইতে পারতেছে না ভয়ে।’ অপর এক প্রতিবেশী মঞ্জু বেগম বলেন, ‘কেউ ডাউটই (সন্দেহ) করে নাই শামীম পোলাটা এমুন। ধরা তো খাইছে।’
