নরসিংদীতে কিশোরী আজিজা আক্তারকে (১৪) মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ পরিবার থেকে করা হলেও পুলিশ বলছে ভিন্ন কারণ। পুলিশ বলছে, পরিবারের ওই অভিযোগের সত্যতা মিলছে না। চাচির অনৈতিক সম্পর্কের কথা জেনে ফেলায় আজিজার ওপর ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা নেমে এসেছিল। প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।
গত শুক্রবার রাতে কে বা কারা আজিজাকে তুলে নিয়ে হাত-মুখ বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। শনিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে মারা যায়। তাদের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর থানার খৈনকুটে।
আজিজাকে হত্যার অভিযোগে শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বাবা আবদুস সাত্তার চারজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করে শিবপুর থানায় মামলা করেন। পুলিশ রাতেই এজাহারভুক্ত আসামি তমুজাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে।
শিবপুর থানার ওসি মো. সৈয়দুজ্জামান গতকাল রোববার বলেন, মোবাইল ফোন চুরি নয়, চাচির অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলার কারণেই আজিজাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলে তদন্তে তথ্য আসছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে আর কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়েছে, ১৯ অক্টোবর আজিজার চাচি বিউটির মোবাইল ফোন চুরি হয়। এ জন্য তিনি আজিজাকে দোষারোপ করেন। বিউটি ফোনটি ফেরত চান এবং হুমকি দেন, ফোন ফেরত না দিলে আগুনে পুড়িয়ে মারবেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মুরগির খামারের জন্য কেরোসিন তেল আনতে আজিজা খৈনকুট বাজারে যায় এবং মিজানের দোকান থেকে এক লিটার কেরোসিন তেল কিনে বাড়ির দিকে রওনা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ পশ্চিমে রবিউল্লাহ ফরাজির বাগানে চিৎকার শুনে ও আগুন দেখে লোকজন গিয়ে পানি দিয়ে আজিজার শরীরের আগুন নেভায়। তারপর দ্রুত নরসিংদীর ১০০ শয্যার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আজিজাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন।
এজাহারে বলা হয়, ঢাকায় নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে আজিজা বলেছে, কেরোসিন তেল নিয়ে বাড়ি আসার সময় বিউটি, রুবেল, তমুজা, সানোয়ারা এবং আরও তিনজন জোর করে রবিউল্লাহ ফরাজির বাগানের বেলগাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে, তার হাতে থাকা কেরোসিন তেল শরীরে ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। বেলগাছে বাঁধা রশি আগুনে পুড়ে গেলে সে চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে ১০০ গজ এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, গ্রেপ্তার তমুজা বেগম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, চাচির অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি দেখা ফেলায় আজিজাকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর ঘটনা ভিন্ন খাতে ঘোরাতে মোবাইল ফোন চুরির অপবাদ দেওয়া হয়।
খৈনকুট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই বিদ্যালয়ে আজিজা এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিয়মিত পড়েছে। অসুস্থতার কারণে অভিভাবকেরা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। আজিজা শান্ত স্বভাবের ছিল। তার সম্পর্কে কারও অভিযোগ ছিল না। এমন একটা মেয়েকে এভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো, এটা মানা যায় না।
শিবপুর সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রেজওয়ান আহমেদ বলেন, মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার ও ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে কাজ করছে পুলিশ। স্বল্প সময়ের মধ্যেই অন্য আসামিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
এদিকে আজিজাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এই সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি রেবেকা মমিনের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য মো. মোজাম্মেল হোসেন, ফজিলাতুন নেসা ও মনোয়ারা বেগম বৈঠকে অংশ নেন।
আজিজাকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে তারা এই দাবি জানায়।
ফরিদপুরে সমাবেশ
ফরিদপুর অফিস জানায়, নরসিংদীতে আজিজা হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর মহল্লায় রিয়াজউদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোর্শেদা নারগিসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শামসুল আলম, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শিবপদ দে, সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু আহাদ প্রমুখ।