ফেসবুক পোস্টে নবী মোহাম্মদকে কটুক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর ভোলার বোরহানউদ্দিনের লোকজনের মনে এখনো রয়েছে ক্ষোভ, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা।
একদিকে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে সেই ফেসবুক পোস্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চারজনের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ আলেম ও স্থানীয়রা, অন্যদিকে হিন্দু বাড়িঘর মন্দিরে হামলা নিয়েও তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক ফেসবুক আইডি থেকে ইসলামের নবীকে কটুক্তি করার খবর ছড়ানোর দুদিন পরে ভোলায় সৃষ্টি হয়েছিল সহিংস পরিস্থিতির।
অথচ সংঘর্ষের আগের দুদিন ধরেই বিপ্লবকে নিয়ে পুলিশ প্রশাসন, অভিযুক্ত হ্যাকার এবং আলেম সমাজে চলছিল নানামুখী তৎপরতা।
গত ১৮ই অক্টোবর বিপ্লব বোরহানউদ্দিন থানায় করা জিডিতে ‘তার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে অন্য কেউ ইসলামের নবীকে কটুক্তি করে পোস্ট এবং মেসেজ পাঠাচ্ছে’ এ অভিযোগ করেন। জিডি করতে বিপ্লবের সঙ্গে গিয়েছিলেন তার চাচা অসীম কুমার বৈদ্য।
তিনি বলেন, মোবাইল ডাটা বন্ধ করে বিপ্লব সেদিন মাঠে কাজ করতে গিয়ে ফিরে এসে বিতর্কিত পোস্টের কথা জানতে পারেন।
“কাতার থেকে প্রথম এক লোক ফোন দিয়েছিল বলে জানায় বিপ্লব। ফেইসবুক আইডিতে পরিচিত আর কি। কাতার থেকে এক লোক ফোন দিয়ে বলে, বিপ্লব তুমি এগুলো কী লিখতেছো? বিপ্লব বলল, আমার তো ডাটাই বন্ধ আমি কী লিখবো? এরপর পাশের বাড়ির মিজান নামে একটা ছেলে বলতেছে, আরে মিয়া এগুলা আমারে কী মেসেজ লিখতেছেন। কিন্তু তখনো বিপ্লবের মোবাইলে ইন্টারনেট ছিল না, ডাটা বন্ধ ছিল” – বলেন মি. বৈদ্য।

সহিংসতার সময় আগুনে পোড়া মোটরবাইক
তিনি বলেন, “মানুষ ফোন করার পরে আমরা জানতে পারলাম যে এরকম সমস্যা হইছে।”
অসীম কুমার জানান, বিপ্লব থানায় জিডি করতে যাবার পথে চাচা অসীম কুমার বৈদ্যর ফেইসবুক আইডি ব্যবহার করে লাইভ করে বলেছিলেন, তার নামের আইডি হ্যাক করে এসব বক্তব্য এবং বার্তা বন্ধু তালিকায় থাকা লোকজনকে পাঠানো হচ্ছে।
বিপ্লব জিডি করার পর পরই একজন ফোন করে তার কাছে টাকা দাবি করে।
ভোলা জেলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, “যে নাম্বার থেকে দুই হাজার টাকা চেয়েছিল – তাকে কিন্তু আমি ১২ ঘণ্টার মধ্যে পটুয়াখালী থেকে আটক করে নিয়ে আসি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুজনকে আমরা মুখোমুখি করি।”
এদিকে ১৯শে অক্টোবর বোরহানউদ্দীনে প্রথম এ নিয়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়।
বোরহানউদ্দিন ঈদগা মারকাজ মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল উদ্দীন বলেন, আসরের নামাজের সময় তারা জানতে পারেন যে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের একজন ফেইসবুকে কটুক্তি করেছে। এ নিয়ে বিকেলে তারা একটি বিক্ষোভ করেন।
“আমরা বিক্ষোভ করে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার পরামর্শে বসলাম। পরামর্শ বসে সিদ্ধান্ত হলো এখানে মিছিল হবে, সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কারা কারা দায়িত্ব নেবে স্বেচ্ছাসেবক কিভাবে নিয়োগ দেবে এগুলো সব ঠিক হইলো, দায়িত্ব বন্টন করা হইলো কে পোস্টার করবে, কে ব্যানার করবে – সবকিছু ঠিক হইলো।”
অক্টোবরের ১৯ তারিখ রাতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং আলেমদের বোরহানউদ্দিন থানায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা হয়। সেখানে বিপ্লব এবং তার কাছে টাকা দাবি করা শরীফ দুজনকে আলেমদের সামনে হাজির করা হয়।
ভোলার পুলিশ সুপার বলেন, “ডিসি ওখানে গিয়েছিল, ইউএনও ছিল এবং সোশ্যাল এলিট যারা ছিলেন সবার সামনে তাদের দুজনকে হাজির করে বললাম, আপনারা কথা বলেন। তারাই জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এরপর তারা আমাদের তৎপরতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে পীর সাহেব মহীবুল্লাহসহ আলেম সমাজের সবার উপস্থিতিতে বলা হলো : কালকের প্রোগ্রাম বাতিল।”
পুলিশ সুপার বলছেন, পীর সাহেবসহ আলেমদের সঙ্গে আলোচনার পর রোববারের সমাবেশ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে আলেমদের দাবি, লোকজন আসলে সমাবেশ হবে এমন আলোচনাও সেখানে হয়েছিল।

বোরহানউদ্দিনে গুলির পর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর মন্দিরে হামলা হয়
মাওলানা জালাল উদ্দিন বলেন, “পুলিশ আমাদের বললো যে এই লোকটার মোবাইল হ্যাক হইছে। এটাতো সে দায়ী না। যদি সে দায়ী না হয় তাহলে আপনারা এর বিরুদ্ধে কেন মিছিল করবেন? আমরা বললাম অবশ্যই কথা সঠিক। আমাদের টার্গেট তো কোনো বিশেষ ব্যক্তি না। যেই এটা করছে যেহেতু এটা তার মোবাইলে আসছে, হয় সে করছে, নয়তো আরেকজন ব্যক্তি এটা করছে – তাইলে সে দোষী। বের করার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদের আন্দোলনটা হচ্ছে যে কাজটা করছে তার বিরুদ্ধে। তাকে আপনারা চিহ্নিত করবেন, শাস্তি দিবেন।”
এদিকে রোববার যেন সমাবেশ না হয় তা নিয়ে তৎপর ছিল প্রশাসন। কারণ বিক্ষোভ সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল পুলিশের।
রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলেমদের আলোচনা চলে বোরহানউদ্দিন থানায় এবং সিদ্ধান্ত হয় ফজরের নামাজের সময় সবগুলো থানার মসজিদে মাইকিং করে প্রচার করা হবে যে সমাবেশ স্থগিত।
এদিকে সমাবেশ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হলেও সেটির প্রচার ঠিকমতো হয়নি সেটি স্পষ্ট।
সকালেই সেখানে ১৭টি মাইক বসানো এবং ছোট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। আর পূর্বঘোষিত সমাবেশে যোগ দিতে রোববার সকালে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় মাঠে।
আলেমদের দাবি, পুলিশ আগেই মাইকে কথা বলে সমাবেশ শেষ করার জন্য তাগাদা দিয়েছে। সাড়ে দশটার মধ্যেই মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শেষ করা। কিন্তু তারা যখন সমাবেশ শেষ করেন তখন মানুষের আসা মাত্র শুরু হয়েছিল।
জালালউদ্দীন বলেন, “যদি সাড়ে দশটায় শেষ না করে এগারটা পর্যন্ত নেয়া যাইতো আর যে লোকগুলাকে আগে আমরা কথা বুঝায়ছি তারা কিন্তু সান্ত্বনা পেয়ে গেছে। আস্থা তাদের তৈরি হইছে। কিন্তু বাকি যে লোকগুলা পৌঁছতে পারে নাই আমাদের মাইক বন্ধ হয়ে গেছে তাদের মধ্যেই কিন্তু এই একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইছে যে কেন মাইক বন্ধ হইছে, কেন এখানে সমাবেশ হইলোনা?”
তবে পুলিশের দাবি সমাবেশ বন্ধ করতে তারা কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সমাবেশ সাড়ে দশটা নাগাদ শেষ করে দেয়াতেই পরে মিছিল নিয়ে আসা মানুষেরা বিক্ষুব্ধ হয়।

ঈদগাহ সংলগ্ন এই ভবনটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা
প্রতিবাদ করতে আসা উত্তেজিত জনতার মধ্য থেকেই এক পর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়লে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
এদিকে ভোলার ঘটনায় আলেমদের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন গুলিতে নিহত মাহফুজুর রহমানের মামাতো ভাই।
তিনি বলেন, “আলেম সমাজ কেন সমাবেশ ডেকে আগেই শেষ করে দিল। আলেমরা তাদের স্বার্থে এই লোক দেখানো প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন। তারা ইসলামকে ভালবেসে নবীর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এ সভা ডাকেন নি। যদি প্রতিবাদ সমাবেশ আগেই শেষ করা না হতো – তাহলে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না।
গুলি না চালিয়েও উত্তেজিত জনগণকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো
আলেমরা আরো মনে করেন, পুলিশ চাইলে গুলি না চালিয়েও উত্তেজিত জনগণকে ছত্রভঙ্গ করা যেত।
আর সমাবেশ করতে দিলে তাদের স্বেচ্ছাসেবকরাই হিন্দু এলাকা পাহারা দিতেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারতো না।
পুলিশ কেন শুরুতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করলো না, থানা থেকে বা ভোলা থেকে ফোর্স ডাকা হলো না। এমনকি কাছেই ফায়ার সার্ভিস ছিল – তাদের ডেকে পানি ব্যবহার হলো না কেন, এসব প্রশ্ন তাদের।
এদিকে ফেইসবুক পোস্টকে ঘিরে অতীতে সব ঘটনাতেই অভিযুক্ত হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্পদায়ের বাড়ি ঘর উপাসনালয়ে হামলা হয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করে এ ঘটনায় বোরহানউদ্দীনের রবীন্দ্র পল্লীতে আগে থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি।
থানা থেকে মাত্র দুশ’ গজ দূরের হিন্দু পল্লীর প্রবেশমুখে পুলিশের পাহারা থাকলেও এ ঘটনা এড়ানো যেত বলেই মনে করেন আক্রান্তদের অনেকে।
পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, যেহেতু তারা নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আলেম সমাজ আশ্বস্ত হয়ে সমাবেশ বাতিল করেছেন তাই তারা এসব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেননি।
“আর উত্তেজিত জনতা এতটাই আক্রমণাত্মক এবং মারমুখী হয়ে গিয়েছিল যে শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থেই শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ” – বলেন তিনি।
সূত্র: BBC Bangla