রাঙামাটি শহরে গতকাল রোববার ভোররাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কখনোবা মাঝারি বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে মনিঘোনা গ্রামে যাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে এল। হাল ছাড়লাম না। ছাতা মাথায় রওনা হলাম ওই গ্রামের পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের খোঁজ নিতে। গত ৭ সেপ্টেম্বর অনেকটা তড়িঘড়ি করে জেলা প্রশাসন রাঙামাটির সব আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ায় বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ফিরে যান ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। কেউ এসে এখন আর তাদের খোঁজ নেয় না।
গত ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে এই গ্রামের ২২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ১২টি আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি। একই পরিবারের তিনজনসহ ছয়জন নিহত হন।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী-রাঙ্গাপানি সড়ক হয়ে অটোরিকশা নিয়ে যুব উন্নয়ন এলাকায় থামলাম। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ ধরে অনেকটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম কিনা মনিঘোনা গ্রামে। গ্রামটির চারদিকে পাহাড়ঘেরা। গ্রামে ঢুকতে চোখে পড়ল বালুর মাঠ। চার মাস আগেও নাকি এখানে চাষাবাদ হতো। কিন্তু পাহাড়ধসে এই কৃষিজমিতে এখন আর কোনো ফলন সম্ভব নয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামে ২২ পরিবারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫ পরিবার ফিরে এসেছে। জেলা প্রশাসন থেকে সহায়তার ছয় হাজার টাকা আর ধার করে এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি নতুন ঘর নির্মাণ করেছে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। বাকি ১২ পরিবার আংশিক বিধ্বস্ত বাড়িঘর সংস্কার করে কোনো রকমে বসবাস শুরু করেছে। ফিরে না আসা সাত পরিবার এখনো আত্মীয়স্বজনের কাছে রয়ে গেছে।
জীবন বসু চাকমা। ১৩ জুন পাহাড়ধসে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর বাড়িটিও। দুই মাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর বাড়ি সংস্কার করে ফিরে এসেছেন বসতভিটায়। ছবি: সুপ্রিয় চাকমাগ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে নতুন নির্মিত দুটি ঘর। তার একটিতে থাকেন সাধন মালা চাকমা। এখনো পুরোপুরি ঘর নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেননি। ঘরের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়েছে ঘরের বাইরে। তিনি জানান, তাঁদের যে বসতভিটা ছিল, তা পাহাড়ধসে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সেখানে বসবাস কিংবা বাড়িঘর নির্মাণ করার কোনো পরিবেশ নেই। তাই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে প্রশাসন তাড়িয়ে দেওয়ার পর ভাইয়ের জায়গায় ঘরটি নির্মাণ করেন। পাহাড়ধসের ঘটনার পর তাঁদের প্রথমে যুব উন্নয়ন, পরে জিমনেসিয়াম আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। তিনি কিছুটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন থেকে পাওয়া দুই বান্ডিল টিন দিয়ে তো আর ঘর হয় না…ছয় হাজার টাকা দিয়ে তো একটা ঘর হয় না! আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে কিছু ধার করে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার চেয়ে বেশি ঘর নির্মাণের পেছনে খরচ হয়েছে।’
নতুন ঘরেও নিরাপদ নন সাধন মালা চাকমা। সব সময় আতঙ্ক। নতুন ঘরটিও পাহাড়ের নিচে। পাহাড়ধসের আগে পাহাড়ি শাকসবজি বাজারে সংগ্রহ করে ও হাঁস-মুরগি পালন করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। কিন্তু পাহাড়ধসের পর আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এখন ধার করে সংসার চালাচ্ছেন। স্বামীও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। শুধু সাধন মালা চাকমা নন, পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ওই গ্রামের অনেকের অবস্থা এখন এমন।
সাধন মালা চাকমার বাড়ি থেকে ৪০০ গজ দূরে পুদি চাকমাদের বাড়ি। যে জায়গায় পুদি চাকমার বাড়ি ছিল, পাহাড়ধসের পর সেটা এখন বালুর মাঠ। এখনো সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ধ্বংসস্তূপের চিহ্ন। একপাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে উদ্ধার করা টিন, কোথাও ছেঁড়া বইয়ের টুকরো, কোথাও জামা-কাপড়, স্যান্ডেল-জুতা। নিজের ভিটায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুদি চাকমা জানান, নতুন বাড়ি নির্মাণ করার সামর্থ্যটুকু তাঁর নেই। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয় বাড়িতে।
পুদি চাকমাদের বাড়ি ঘেঁষে জীবন বসু চাকমার বাড়ি। পাহাড়ধসে ঘটনায় তাঁর বাড়িটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামের সবার সঙ্গে তিনি প্রথম আশ্রয়কেন্দ্রে যান। প্রথমে পৌর উচ্চবিদ্যালয়, পরে জিমনেসিয়াম আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। জেলা প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটি সংস্কার করে কোনো রকমে বসবাস করছেন।
বাড়ির আঙিনায় বসে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় জীবন বসু চাকমা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমরা এখানে নিরাপদ নই। আমাদের চারদিকে পাহাড়। বর্ষা মৌসুম এলে আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে। গ্রামের দুই দিকের পাহাড়ের মাঝখানে আমরা এবং দুই পাহাড় ধসে গেছে। আপনারা এসে দেখুন, কী অবস্থায় আমরা আছি!’
রাঙামাটি শহরের অলিগলিতে জামাকাপড়ের ফেরি করে বেড়াতেন জীবন বসু চাকমা। পাহাড়ধসের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি সংস্কারে জমানো টাকা পুরোটাই খরচ করেন। পুঁজি না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে আয়ের উৎস। চার মাস ধরে বেকার বসে আছেন।
জীবন বসু চাকমার বাড়ির পূর্ব পাশে আরেকটি বাড়ি। পাহাড়ধসে মারা যান, সেই বাড়িতে থাকা এক মা ও ছোট মেয়ে। বেঁচে যান বাবা কল্পরঞ্জন চাকমা ও তাঁর আরেক মেয়ে লতিকা চাকমা। ঘটনার দিন ভোর চারটায় যখন পাহাড়ধস শুরু হয়, তখন ওই বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দ ও চিৎকার শুরু হলে প্রতিবেশী জীবন বসু চাকমা দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন, বাড়িটি ততক্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় বড় মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। ওই সময় ব্যবসার কাজে কল্পরঞ্জন চাকমা বাইরে ছিলেন। দুর্ঘটনার এক দিন পর মা-মেয়ের লাশ স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে। ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া বাবা-মেয়ে তাঁদের বসতভিটায় আর ফিরে আসেননি। কোথায় তাঁরা চলে গেছেন, প্রতিবেশীরা কেউ বলতে পারেননি।