একটি ভালো উদ্যোগ কিভাবে নষ্ট হয় তার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি করল বিএনপি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দলটি।
সে অনুযায়ী ঢাকায় অবস্থানরত সিনিয়র নেতারা চিঠির খসড়া তৈরির প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছু না জানিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর এসংক্রান্ত একটি চিঠি ডাকযোগে বিশ্ব সম্প্রদায়কে পাঠান বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির।
সূত্রমতে, এ ঘটনায় দলটিতে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং সিনিয়র নেতারা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা নওশাদ জমিরকে ডেকে চিঠির বিষয়ে ব্যাখ্যা চান। শুধু তাই নয়, কী ধরনের চিঠি তিনি পাঠিয়েছেন তার কপিও দিতে বলেন দলটির সিনিয়র নেতারা। একপর্যায়ে নওশাদ জমির ওই চিঠির একটি কপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পৌঁছে দেন বলে জানা যায়। এর পরই থেমে যায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে চিঠি দেওয়ার বিএনপির কেন্দ্রীয় উদ্যোগ।
অনেকের মতে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের লন্ডন থাকা অবস্থায় ঢাকা ও লন্ডনের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে। আবার কারো মতে, নওশাদ জমিরের একক ইচ্ছা বা উদ্যোগে ওই চিঠি যায়নি।
নিশ্চয়ই এ বিষয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুমতি আছে। কারণ তারেকের সঙ্গে জমিরের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। যে সম্পর্কের সূত্র ধরেই ওই চিঠি পাঠানো হতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। অন্যদিকে চিঠির ব্যাপারে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুমতি নেওয়া হলেও তা কী প্রেক্ষিত বা প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে সে বিষয়েও নানা আলোচনা আছে আরেক অংশের মধ্যে। সব মিলিয়ে দলে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একজন অন্যজনের সঙ্গে দেখা হলেই জানতে চাইছেন, আসলে কী ঘটেছে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে নওশাদ জমিরের সঙ্গে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও ‘প্রাকটিশনার’ আইনজীবী হিসেবে নওশাদ ঢাকাতেই বসবাস করেন। এক-এগারো পরবর্তী সময়ে ইতিবাচক ভূমিকার কারণে দলের মধ্যে লাইমলাইটে আসেন তিনি। গত কাউন্সিলের পর তাঁকে দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়।
কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে নওশাদ জমির অবশ্য দাবি করেন, খালেদা জিয়ার নির্দেশেই তিনি ওই চিঠি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশ, ওআইসিভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছে পাঠিয়েছেন। তবে ঢাকায় অবস্থানরত বিএনপির প্রায় সব সিনিয়র নেতা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন, ওই চিঠি সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা নেই।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি এবং আপাতত ওই ধরনের কোনো চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনাও নেই। দলের পক্ষ থেকে বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়ে তত্পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চিঠি দেওয়াও হয়নি, এ বিষয়ে কিছু জানিও না।
বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা বিষয়ে সাধারণত লিখিত কোনো বিষয় বা ড্রাফটের প্রয়োজন হলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ রহমান এবং দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের ওপর দায়িত্ব পড়ে। কালের কণ্ঠকে তাঁরা বলেন, ‘চিঠির বিষয়ে তাঁদের কিছু জানা নেই। ড. রিপন বলেন, চিঠি লেখার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আমি পাইনি। ’
তাহলে নওশাদ জমিরের চিঠিটা কী সংক্রান্ত জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা এ বিষয়ে তাঁকেই জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন। এমন প্রশ্নে অবশ্য নওশাদ জমির অকপটে স্বীকার করেন, চিঠিটা নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলেও এখন তা মিটে গেছে। তিনি এও জানান, খালেদা জিয়ার পক্ষে চিঠিতে তিনিই স্বাক্ষর করেছেন এবং বিষয়টি তারেক রহমানেরও জানা ছিল।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সরকার চিঠি দেওয়ার পরই বিএনপিও একই সিদ্ধান্ত নেয়। দলটির মনে হয়েছে, এ ধরনের চিঠি দেওয়া হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ‘গতিশীল’ আছে এ বার্তা যেমন দেশ-বিদেশে স্পষ্ট হবে, পাশাপাশি এ ধরনের চিঠি গণমাধ্যমেও বিশেষ গুরুত্ব পাবে। ফলে লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরুর পাশাপাশি চিঠি দেওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে কথাও বলেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠকে মির্জা ফখরুল (প্রকাশিত) বলেন, চিঠি দেওয়ার কথা বিএনপির অনেকে বলছেন, কিন্তু চূড়ান্তভাবে কী করব এখনো ঠিক করিনি। দেখি কী করি! এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারকে চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে’ বলে ওই দিনই আরেকটি গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। দলের আরো দু-একজন সিনিয়র নেতা গণমাধ্যমে এমন আভাস দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকার মাত্র দু-তিনটি গণমাধ্যমে চিঠির ওই ঘটনা ‘ফাঁস’ করে দেন নওশাদ জমির, যা দেখে বিস্মিত হন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তাঁরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে দলের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। কারণ মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অজ্ঞাতে এ ধরনের চিঠি দেওয়ার ঘটনায় দলের চেইন অব কমান্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পাশাপাশি ওই ইস্যুতে চিঠি দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। কারণ একই ইস্যুতে দুই বার চিঠি দেওয়া যায় না। তা ছাড়া ওই চিঠি দেওয়ার উদ্দেশ্যও এখন আর সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ কয়েকটি গণমাধ্যমে এসংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ায় দ্বিতীয়বার একই ইস্যুকে তারা গুরুত্ব দেবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির পরস্পরবিরোধী নেতাদের বাধায় ইতিবাচক অনেক উদ্যোগই গত ১০-১৫ বছরে দলটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর মধ্যে ক্ষমতায় থাকাকালে অষ্টম সংসদে সরকারি দলে ও নবম সংসদে বিরোধী দলের একজন উপনেতা নির্বাচন না করতে পারা, উদ্যোগ নিয়েও বিগত জোট সরকারের মন্ত্রিসভা ছোট না করতে পারা, দলের একাংশের প্রস্তাব সত্ত্বেও দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়াসহ অনেক ঘটনা দলের মধ্যে এখনো আলোচনার বিষয় হয়ে আছে।