বিএনপির প্রতি এখনও কঠোর সরকার। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে দলটিকে রাজপথে নামতে দেয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপির মানববন্ধনের পর ত্রাণ বিতরণে বাধা দেয়া হয়। তবে সরকারের এ ধরনের আচরণকে উসকানি বা ফাঁদ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এসব উসকানি এড়িয়ে পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে বিএনপি। দু’দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নাজুক দলটি হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিকল্পিতভাবেই এগোতে চাইছে। সরকারের নানা মহল থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বিএনপিকে পুনরায় আন্দোলনের উসকানি দেয়া হচ্ছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন। কিন্তু এতে কান না দিয়ে বিএনপি ধীরে চলো নীতিতে সামনে এগোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে
জনসম্পৃক্ত ইস্যুকেই গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো সংঘাতে জড়াতে চায় না দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচনের জন্য দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির দিকেই নজর তাদের।
জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বেশ সক্রিয়। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বন্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যু ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছেন তারা। যদিও এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক পরামর্শ নেয়া হয়েছে। আর জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে সিনিয়র নেতারা সক্রিয় হওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত। তবে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এখনও কিছুটা মনোমালিন্য রয়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও দলের চেয়ে স্ব স্ব সমর্থকদের প্রতি তারা অধিক মনোযোগী বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত দু’বছর ধরে বিএনপি অনেকটা ইতিবাচক রাজনীতি করছে। সংঘাত বা সহিংসতা এড়িয়ে তারা সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় দলটি। কিন্তু এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়েও সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপির মানববন্ধনে ১৮ জেলায় বাধা দেয়া হয়। ত্রাণ বিতরণও করতে দেয়া হয়নি। তারপরও বিএনপি এর প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি কয়েক বছর ধরেই ইতিবাচক রাজনীতি করছে। সরকারের উসকানিতে পা না দিয়ে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে সোচ্চার ছিল দলটি। পাশাপাশি সংগঠন গোছানোর দিকে নজর দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘রাজপথে সক্রিয় না থাকলেও বিএনপির প্রতি সরকারের মনোভাব এখনও অনেকটা কঠোর। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেয়। এমনকি তাদের ত্রাণ বিতরণও করতে দেয়া হয়নি। বিএনপি মানবিক কাজে এগিয়ে এলেও সরকার অনেকটা অমানবিক আচরণ করেছে।’
জানা গেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে এলেও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে দলটি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে ‘বাজারে আগুন, জনজীবন বিপর্যস্ত’ শিরোনামে একটি পোস্টার দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয় বিএনপি। দেশে গণতন্ত্রহীন সংস্কৃতি, সরকারের অপশাসন ও অন??্যায়-অত্যাচার তুলে ধরে খালেদা জিয়ার নাগরিক সচেতনতামূলক একটি গণচিঠি তৃণমূল পর্যায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের একচেটিয়া দখলসহ নানা অনিয়ম ছাত্র সমাজ তথা জনগণের মধ্যে তুলে ধরেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এ ছাড়া ছাত্রদলকে তার ২৫ দফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যের সমন্বয়ে একটি গণমুখী আন্দোলনের লক্ষ্যে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি সরকারের ক্রমাগত অমানবিক অবহেলা তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের একটি যৌক্তিক আহ্বান সারা দেশের সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয় শ্রমিক দল। এ সময় বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর জেলা পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের স্বহস্তে পোস্টার লাগানো ও লিফলেট বিতরণ করতে দেখা যায়; যার মাধ্যমে নেতাকর্মীরা উৎসাহিত হয়েছেন।
তৃণমূল পর্যায়ে জনমত সৃষ্টিতে দলের এসব কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল এবং জাসাসের প্রায় সব পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন ও দলীয় নানা কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের প্রাণচাঞ্চ?ল?্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকারের গুম-খুন, মামলা-হামলাকে উপেক্ষা করে বিএনপির নেতাকর্মীরা আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর সরকারের অত??্যাচার ও নিপীড়ন বিএনপির নেতাকর্মীদের মানসিক শক্তি ও উদ্যম বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে পুনরায় সুসংগঠিত হতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন তারা।
কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন করে অবকাশ ও শক্তি সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণমুখী কর্মপরিকল্পনায় হাত দেয় বিএনপি। কাউন্সিলের পর দলের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। এরপর জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলা দল, জাসাস, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, চট্টগ্রাম মহানগরসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলকে নতুন আঙ্গিকে সাজান খালেদা জিয়া। মূল দলের পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদলও স্বেচ্ছাসেবক দল তাদের জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করায় মনোনিবেশ করে। অর্ধেকের বেশি কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। জেলা, থানা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিগুলো ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
খালেদা জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০ জনমনে বেশ আশার সঞ্চার করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। দলটি তার ভিশনের ১০ লক্ষাধিক কপি ইতিমধ্যে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। নানা সভা-সেমিনারের মাধ্যমে দলটি তার ভিশন-২০৩০-কে সৃষ্টির মাইলফলক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি বিএনপি ১ কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি হাতে নেয়। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ফরম পূরণকার্য সম্পন্ন হয়েছে বলে বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে। বন্যাদুর্গত ও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে দলটি সাধারণ মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার কিছুতেই বিরোধী দলকে সহ্য করতে পারছে না। তাদের আচরণ অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিএনপির ত্রাণ কাজে বাধা দিয়ে সেটার প্রমাণ দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সংঘাত চাই না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাই। সরকারের উসকানি বা ফাঁদে পা দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এ মুহূর্তে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার দিকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’