নাফ নদী হয়ে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। কক্সবাজার শহরের পাহাড়ি এলাকাসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিতে উখিয়া-টেকনাফ থেকে চলে আসছে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা। চট্টগ্রাম-ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্য এলাকায়ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিচ্ছে। চট্ট্রগ্রামে চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গারাও ক্যাম্পে ফিরে না গিয়ে হয় চট্টগ্রামে নয়তো অন্য কোথাও আশ্রয় নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের হঠাৎ এসব এলাকায় আশ্রয় নেয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে স্থানীয়রাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের হয় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো, নয় তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই খালি হাতে এসেছেন। ফলে ক্ষুধা নিবারণে অনেকে ভিক্ষাও করছেন। ফলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না হলে চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভাষা ও শারীরিক গঠনগত মিল থাকায় তারা খুব অল্প সময়ে নগরবাসীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাদের অনেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে কাজ নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মানবকণ্ঠের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বুধবার দুপুরে সিংগাইর থানা পুলিশ নয় সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে চারিগ্রাম এলাকা থেকে উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আবদুল মান্নান জানান, সিংগাইরে রোহিঙ্গা প্রবেশের খবর পেয়ে উপজেলার চারিগ্রামের মাওলানা তাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে নয় রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এদিকে আরেকটি সূত্র জানায়, উপজেলা সদরে শ্রমিকের কাজ করার জন্য বেশ কয়েক রোহিঙ্গা এসেছে। তবে তাদের সন্ধান পায়নি পুলিশ। পুলিশের উপ-পরিদর্শক আবদুল মান্নান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে এরা সবাই আরাকান রাজ্যের মংডু জেলার মন্ডুকাদেরবিল গ্রামের বাসিন্দা।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গার ঢল নামে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকায়। চাপ বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা দালাল অথবা আগে থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে বসবাস করা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি চট্টগ্রামের দিকেও চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। শহরের পাহাড়তলী, বৈদ্যেরঘোনা, ঘোনারপাড়া, খাজামঞ্জিল, লাইটহাউজ, রুমালিয়ারছড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, বিজিবি ক্যাম্প এলাকা, কলাতলী আদর্শগ্রাম, সমিতিপাড়া, চন্দ্রিমা সমিতি এলাকা, নতুন জেলগেট এলাকাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্রোতের মতো ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় আগে থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ও ভাড়া বাসা নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো রোহিঙ্গা শহরে ঢুকে পড়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে স্থানীয়রা আতঙ্কিত।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে যারা আহত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন তারা সুস্থ হয়ে নগরীতেই থেকে যাচ্ছেন। এমনকি তাদের স্বজনরাও আহতদের অজুহাত দিয়ে নগরে থেকে যাচ্ছেন। সবমিলে পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে চট্টগ্রামে। তবে প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে তারা কড়া নজরদারিতে আছে। এমনকি নগরীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশের চেক পোস্ট আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পর চট্টগ্রাম নগরী ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত উপজেলায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও পটিয়ায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। কারণ এ তিন উপজেলায় বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পল্লী রয়েছে। এসব পল্লীতে গত ৫ বছরে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তারা স্থায়ী বসতি করেই সেখানে থাকছে। ওইসব পল্লীতে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ভিড় বেড়েছে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর ইস্পাহানি মোড়ে ১০/১২ জন নারী ও শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা, মিয়ানমারের মংডুর নাটবিল এলাকা থেকে এসেছে বলে জানায়।
এদিকে হাটহাজারী পৌর এলাকার কামাল পাড়ায় অভিযান পরিচালনা করে ১৯ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে এ অভিযান পরিচালনা করেন হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাসুম। আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। বাংলাদেশে আসার পর তারা গত তিন দিন উখিয়ায় অবস্থান করে। পরে হাটহাজারীতে চলে আসে। তাদের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। লোহাগাড়া উপজেলায় গত দু‘দিনে নারী-শিশু ও পুরুষসহ ৩২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। গত সোমবারে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ২১ জন ও মঙ্গলবার দুপুরে ১১ জন রোহিঙ্গাকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়। সোমবার রাতেই ২১ জনকে উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা যাতে চলাচল করতে না পারে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের একাধিক পাহাড়ি এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, প্রচুর রোহিঙ্গা এসে এখানকার কয়েকটি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ এখন পাহাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত আবার পাহাড় কেটে ঘরও তৈরি করছে কেউ কেউ। ফলে কোনো কোনো এলাকায় পাহাড় কাটারও প্রবণতা বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে নিয়ে কাজ করে এমন অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হলেও এভাবে সারাদেশে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়লে তা এক সময নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ঘটতে পারে নানা অঘটন। এক্ষেত্রে আইন শৃংখলা বাহিনীকে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
পরিচয় গোপন করে সুনামগঞ্জে ১২ রোহিঙ্গা, টেকনাফে ফেরত: সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এদিকে মিয়ানমারে অব্যাহত সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে সুনামগঞ্জে পরিচয় গোপন করে থাকা একটি রোহিঙ্গা পরিবারের ১২ জনকে কক্সবাজারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানার ওসি নন্দন কান্তি ধর জানান, শুক্রবার দুপুরে তাদের পুলিশ প্রহরায় টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার গোপন সংবাদ পেয়ে উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের গুটিলা গ্রামের একটি বাড়ি থেকে পুলিশ তাদের আটক করে বলে জানান তিনি। এরা হলেন আবদুস সবুর (৫১), তার স্ত্রী আমিনা বেগম (৪২), ছেলে আবদুল হালিম (২৩), মেয়ে তালিহা আক্তার (১৫), মেয়ে হারিসা আক্তার (১৩), মেয়ে হালিমাতুস সাহিয়া (১১), মেয়ে সাবিহা আক্তার (৯), ছেলে আসলম শাহ (৭), মেয়ে উম্মা বেগম (২), আবদুল হালিমের স্ত্রী উম্মুল খাইরিন (২২) ও মেয়ে মোশারফা (১) এবং হালিমের শ্যালক কাউছার মিয়া (৭)।
তাদের বাড়ি মিয়ানমারের আকিদাবাদ জেলার মংদু থানার কুয়ান শিবং গ্রামে।
ওসি নন্দন কান্তি ধর বলেন, স্থানীয় লোকদের কাছে খবর পেয়ে বড়দল ইউনিয়নের গুটিলা গ্রামের তোতা মিয়ার বাড়ি থেকে রাত ৯টায় তাদের আটক করে তাহিরপুর থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের কাছ থেকে বাদাঘাট বড়দল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত পাঁচটি নাগরিক সনদ ও তিনটি জš§সনদ উদ্ধার করা হয়েছে।
ওসি বলেন, স্থানীয় তোতা মিয়ার এক ছেলে চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেন। সেখানেই রোহিঙ্গা নাগরিক আবদুস সবুরের দুই ছেলেও পড়াশোনা করতেন। সেখানে তাদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে কয়েক মাস আগে এই পরিবারটি চট্টগ্রাম থেকে গুটিলা গ্রামে তোতা মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
গত রোববার ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের চরশাহাভিকারী গ্রামে একটি বাড়িতে ১৩ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নেয়। বিয়ের সূত্রে ওই পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা রয়েছে।
