সব চাপ নিয়ে আগামী একাদশ নির্বাচনী ট্রেনে উঠবেন খালেদা জিয়া। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সব পরিকল্পনা রয়েছে তার। বিএনপিপন্থি একাধিক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপকালে এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ও কেউ কেউ এ ধরনের ইঙ্গিতের প্রতি সমর্থন জানান। তারা প্রকাশ্যে না বললেও তাদের ভাষ্য বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এখন পুরোপুরি নির্বাচনী ট্রেনে অবস্থান করছেন। এদিকে কক্সবাজার সফরে গিয়ে রাস্তায় মানুষের ঢল দেখে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ মহলে আস্থা আরো বেড়েছে।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারকে পজিটিভ রাজনীতিতে থাকতে হবে। দেশের স্বার্থে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি রাস্তা বের করুন, যাতে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়। সে নির্বাচনে মানুষ যেন ভোট দিতে পারে। ফখরুল বলেন, ইসি দুই মাস ধরে যে সংলাপ করেছে সেটি একটা লোক দেখানো আইওয়াস। তিনি বলেন, সংলাপে অংশ নেয়া সবাই বলেছে যে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখন জাতি তাকিয়ে আছে ইসি কি করে? কিন্তু ইসি কিছুই করতে পারবে না। কারণ সরকারের বাইরে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করার শক্তি নেই। এর পরও আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে কী না, যাতে মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে।
এ ব্যাপারে দলটির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, সহায়ক সরকারের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চাপে রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের মূল লক্ষ্য হবে খালেদা জিয়ার স্বপ্ন।
সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একাদশ নির্বাচনে জনগণের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে আবারো ক্ষমতা গ্রহণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ১৮ অক্টোবর লন্ডন থেকে ফিরে ১৯ অক্টোবর আদালতে ন্যায় বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে কেন্দ্র করে আমিসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলার সমস্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও পুরোপুরি বানোয়াট। তিনি বলেন, এ মামলায় বিচারের নামে দীর্ঘদিন ধরে হয়রানি, পেরেশানি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছি।
এ ছাড়া মিথ্যা ও সাজানো মামলায় বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে বন্দি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, প্রায় ৭৫ হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ৪ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ২৫ হাজারের মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে। নির্যাতন, হয়রানি ও গ্রেফতারের ভয়ে বহু নেতা-কর্মী বাড়ি-ঘরে থাকতে পারেন না। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের ঘরে ঘরে আজ কান্নার রোল। তিনি বলেন, এখন সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বড় বেশি বলা হয়। কিন্তু কোথায় আজ সাংবিধানিক শাসন? আমাদের সংবিধান নাগরিকদের যে সব অধিকার দিয়েছে, কোথায় আজ সে সব অধিকার? কোথায় আজ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার?।
দলটির মধ্যম সারির এক নেতা মানবকণ্ঠকে বলেন, লন্ডন থেকে ফিরে খালেদা জিয়া এখন আদালতে বিচারাধীন সব মামলা মোকাবিলা করছেন, আদালতে তার আর্জি উপস্থাপন করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকের পর নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গতি এগোচ্ছে, সাড়ে তিন মাস পর স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আয়োজন করছেন, দেশব্যাপী আক্রান্ত নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
অপরদিকে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে যদি বিএনপি নির্বাচনে যায়, সেক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। সেটিকে মাথায় রেখে এই নেতা বলেন, যার অধীনে হোক এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল ও নেতা-কর্মীদের ধরে রাখতে হবে। তাছাড়া এর বিকল্প অন্য কিছু নেই। বেগম খালেদা জিয়া পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ইফতার মাহফিলে দলের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমরা আগামীর নির্বাচনে যাবো। কারণ আমরা জানি, ফেয়ার নির্বাচন হলে আমরাই জিতব। আর হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েই কেবল নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। কারণ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হয়নি এবং হবেও না। এ জন্য আমরা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলেছি। এটা যে কোনো নামে হতে পারে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ আরেক বারের মতো শিক্ষা দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে আগামী ৬ সিটি কর্পোরশনে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই ও নির্বাচনের প্রস্তুতি, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলার মধ্যে দুই একটির মামলার অপেক্ষমাণ রায়, স্থায়ী কমিটির ৩টি পদে যোগ্য নেতাদের পদায়নের বিষয়, ২০ দলের শরিক দলের নেতাদের আসন ছাড়, জামায়াত ইস্যু, দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানো, সংস্কারপন্থিদের অগ্রাধিকার, সহায়ক সরকারের শিগগিরই রূপরেখা ঘোষণার অপেক্ষায়, প্রার্থী বাছাইয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তারেক রহমান সাজা নিয়ে লন্ডনে অবস্থান, তার দেশে ফেরার বিষয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিরপেক্ষ সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও চলছে খালেদা জিয়ার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগকে আর ছাড় নয়, আগামী নির্বাচনে সব কিছুর চাপ নিয়ে নির্বাচনে লড়বেন বেগম জিয়া। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী এখন পুরোপুরি নির্বাচনী ট্রেনে আছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলা চলবে মাঠে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে একদিকে দ্রুত দল গোছানোর কাজ শেষ করছে বিএনপি, অন্যদিকে দলটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় ও দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
দলটির একাধিক সূত্র জানান, নির্বাচন ও আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি যুগপৎভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে খালেদা জিয়ার বড় বড় জনসভা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই বিএনপি চেয়ারপার্সনকে চূড়ান্ত আন্দোলনের গ্রাউন্ড তৈরির জন্য সারাদেশে জনসভা করার পরামর্শ দিয়েছেন। সিলেট শাহজালালে মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগে খালেদা জিয়ার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবর রহমান শামীম মানবকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি মনে করছে আন্দোলন করেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে মাইনাস করার সাম্প্রতিক তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
দলটির অপর একটি সূত্র জানায়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে ধারাবাহিক বৈঠক চালিয়ে যাবেন বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপির দফতর বিভাগের দায়িত্ব নিয়োজিত এক নেতা বলেন, আগামীতে সব বৈঠকে বিএনপি নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলন কিভাবে চাঙ্গা করা যায় সেদিকে অগ্রসহ হচ্ছে নেতারা।
বিএনপির সূত্র জানায়, সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। বিএনপিকে এসব পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। দলকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। জানা গেছে, চলতি মাসের ২৩ অক্টোবর রাজধানীর গুলশানের বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নানা ধরনের আলোচনা হয়েছে। বেশ কয়েকজন সদস্য নিজেদের অবস্থান তুলে দলের চেয়ারপার্সনের কাছে অনুভূতি প্রকাশ করেন। পরে সিনিয়র নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচন ও নিজ নিজ এলাকার সাংগঠনিক ভিত মজবুত করে কেন্দ্র ঘোষিত যে কোনো কর্মসূচি সফল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। নির্বাচনে অযোগ্য করতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা অন্তত দুটি মামলার রায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) দেয়া হতে পারে। একই সঙ্গে ঝুলে থাকা মামলার রায় দিয়ে শীর্ষ নেতাদেরও নির্বাচনে অযোগ্য করা হতে পারে। এ ছাড়া বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে নানা ফাঁদও পাতা হতে পারে- যাতে করে নির্বাচনের আগে বিএনপি সঠিক রাজনৈতিক কৌশল নেয়ার সুযোগ না পায়।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এসব আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকারে যারা আছেন তারা জনগণকে বাইরে রেখে বহুমুখী নির্বাচনী প্রকল্প নিয়েছেন। এ বহুমুখী প্রকল্প হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় লোকজনের মারফতে নির্বাচন পরিচালনা করা, পুলিশ-র্যাবসহ তাদের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে এবং সরকারের যেসব প্রশাসনিক টাস্ক আছে, সেখানে দলীয় লোকজনকে বসিয়ে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা, বিএনপির জনপ্রিয় নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা-গুম-খুন-হত্যা-জেলে পাঠিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। আমীর খসরু বলেন, এসব প্রকল্প সফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জানা গেছে, এসব শঙ্কা আমলে নিয়েই সাংগঠনিক পরিকল্পনা করছে বিএনপি। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নজর দেয়া হয়েছে তৃণমূল পুনর্গঠনের গতি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো দ্রুত ঢেলে সাজানোর টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ৭৫ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে বেশি জেলার পুনর্গঠন কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠনও চলছে পুরোদমে। সম্প্রতি মহিলা দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাসাসের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এসব দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজও চলছে।
এ পর্যন্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গনি, হান্নান শাহ ও সর্বশেষ এক কে আনোয়ারসহ তিন জনের মৃত্যুতে তাদের পদগুলোতে যোগ্য লোকদের পদায়ন করা নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নেতা বলেন, দ্রুত সময়ে সব কিছু মোকাবিলা করে খালেদা জিয়া নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোরেশোরে। এদিকে শনিবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প পরিদর্শনে যান খালেদা জিয়া। নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে এ সফর সড়ক পথে আয়োজন করা হয়। জনগণের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের আস্থা বেড়েছে বিএনপির শীর্ষ মহলে।
স্মার্ট নিউজ টোয়েন্টিফোর