একই দিনে দুর্নীতি নিয়ে দুটি খবর। ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত খবরে দেখলাম, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, ‘বন্যা-পরবর্তী সংস্কারকাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে, তবে হরিলুট হবে না।’ সিপিডি আয়োজিত এ সংলাপে দেশের বন্যা, দুর্যোগ ও পানিবিশেষজ্ঞরা বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনকাজে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি মন্ত্রীরা বাঁধ নির্মাণ বা মেরামতের কাজে দুর্নীতির বিষয়ে সজাগ থাকতে বলেছিলেন।
অন্যদিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং দুর্নীতির বাঘ, মাছি ও শিয়ালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার কথা বলেছেন।
দুর্নীতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড়া না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে চীনের এই নেতা বলেন, ‘আমরা নামকাওয়াস্তে আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, আত্মপরতা, বিলাসিতা ও সুবিধালাভের চেষ্টার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি।…কোথাও কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা দেখানো হচ্ছে না। বাঘ, মাছি, শিয়াল—সবার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
দুর্নীতি নিয়ে আমাদের মন্ত্রী এবং চীনের প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাকটি দেখুন। আমাদের মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে কোনো দুর্নীতি হয় না, এমন কথা আমি বলব না। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে, এটা আমি মানতে রাজি না।’
মন্ত্রীর বক্তব্যের আগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও বাঁধ মেরামতে হরিলুট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনকাজে সরকারকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন। তিনি এসব কাজ থেকে সাংসদদের দূরে রাখা এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন। এবারে হাওরের বন্যার সময় সাংসদদের কাছে পাওয়া না গেলেও তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ নারী-পুরুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁধ রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
আইনুন নিশাত মন্ত্রীকে হরিলুট সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন আর মন্ত্রী মহোদয় তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘হরিলুট হবে না, লুটপাট হতে পারে।’ বাংলা অভিধান অনুযায়ী হরিলুটের চেয়ে লুট বা লুটপাট শব্দটি অধিক বিপজ্জনক। মন্দিরে সংকীর্তনের পর ভক্তদের উদ্দেশে যে বাতাসা বিলানো হয়, তাকে হরিলুট বলে। সেবায়েতরা বাতাসা না বিলালে কেউ তাঁর কাছ থেকে লুট করে নেয় না। আর লুট হলো অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ আত্মসাৎ বা ডাকাতি করা। এখানে জনগণের সম্পদের কথাই বোঝানো হয়েছে। বন্যার হাত থেকে মানুষ ও ফসল বাঁচাতে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, তা কোথায় কীভাবে খরচ হলো সেটি জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। কেননা এসব বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের অর্থ মন্ত্রী ও পাউবোর কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের পকেট থেকে দেন না।
আইনুন নিশাতের সতর্কবাণী মন্ত্রী ইতিবাচকভাবে না নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের পক্ষে কেন সাফাই গাইলেন, তা বোধগম্য নয়। দুর্নীতির কারণে যদি হাওরের বাঁধ না ভেঙে থাকে তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন কেন ঠিকাদারদের পাশাপাশি পাউবোর প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করল?
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কারণে বন্যা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশের উজানে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম বৃষ্টি হওয়ায় বন্যার পানি বাঁধ উপচে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। হাওরে বাঁধ উপচে পানি ঢোকার পাশাপাশি ৫০০টি স্থানে কৃষক বাঁধ কেটে দেওয়ায় সেখান দিয়েও পানি ঢুকেছে। আর দিনাজপুরে বাঁধের ওপরে একটি ফুলগাছ ছিল। সেটি ভেঙে গিয়ে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বন্যা হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় ইঁদুর এসে বাঁধ ফুটো করে দেওয়ায় সেখান দিয়ে পানি ঢুকেছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে এবং সেই বৃষ্টির পানি বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি বন্যার খবরটি আগাম পেত, যদি বাঁধগুলো ঠিকমতো মেরামত ও সংস্কার হতো, তাহলে ইঁদুরের গর্ত কিংবা ফুলের গাছ ভেঙে বাঁধ ভাঙত না। পাউবোর কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেছেন বলে বন্যা হয়নি। তাঁরা দুর্নীতি করেছেন বলে বাঁধের কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল ছিল এবং বন্যায় তা সহজে ভেসে গেছে। মন্ত্রী মহোদয় এই সরল সত্যটি স্বীকার করলে পাউবোর কর্মকর্তারা কিছুটা হলেও সজাগ হতেন। এখন হয়তো মন্ত্রীর বক্তব্যকে তাঁরা সততার সার্টিফিকেট হিসেবে নেবেন। দুর্নীতির রাশ টেনে ধরাই মন্ত্রীর দায়িত্ব; দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাওয়া নয়।
বাংলাদেশের মন্ত্রী বাঘ দূরের কথা, মাছিদের গায়েও হাত দিতে চান না। এটাই দুর্ভাগ্য।